প্রকাশিত:
১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:২৫
দেশের ফার্নিচার শিল্পের বেশিরভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এসকল কাঁচামাল আমদানির পর ফার্নিচার তৈরি করে তা বিদেশে বিক্রি করলে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না।
যে কারণে ফার্নিচার রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। দেশের ফার্নিচার খাতকে আরো বেশি রপ্তানিমুখী করতে বন্ড বা কর ছাড় সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
এবার ব্যবসায়ীদের এ আশা পূরণে সুখবর জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশের ফার্নিচার শিল্পকে রপ্তানিমুখী করতে ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের বন্ড সুবিধা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব। একই সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সঙ্গে আলাপ করে এবিষয়ে খুব শীঘ্রই কার্যকরী পদ্ধতি বের করা হবে। যাতে করে ফার্নিচার শিল্পের রপ্তানির পরিমাণটা বাড়ে।
মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর কুড়িলে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় গুলনকশা, পুষ্পগুচ্ছ (হল-১,২) ‘১৮ তম জাতীয় ফার্নিচার মেলা ২০২৩’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি (বিএফইএ)। দেশীয় ফার্নিচার শিল্পের সর্ববৃহৎ এ আয়োজন চলবে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত। মেলায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মোট ১৮৫টি স্টল রয়েছে।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যে পরিমাণ ফার্নিচার রপ্তানি হবে, সেগুলো তৈরি করতে যে সকল কাচামাল আমদানি করতে হবে, তার উপর বন্ডের বা কর ছাড় সুবিধা চায় ব্যবসায়ীরা। আর এই বন্ড সুবিধা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে এ বিষয়ে পদ্ধতি বের করা হবে। যাতে করে রপ্তানির পরিমাণটা বাড়ে।
ফার্নিচার শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে চেলেঞ্জ গুলো উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা যে ফার্নিচার তৈরি করি, তার উপরের যে কাপড় সেটা আমাদের দেশে তৈরি হয় না। এর জন্য যে নাট- বল্টু, স্ক্রু সেটাও আমাদের দেশে হয় না। ব্যবসায়ীদের আমদানি করতে হয়। আর রমেটেরিয়াল আমদানি করে, তারপর ফার্নিচার তৈরি করে যদি রপ্তানি করা হয়। তাহলে সে ক্ষেত্রে ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাবে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রপ্তানি করার আগে যে সকল রমেটেরিয়াল তারা আমদানি করবে তার উপর যেন বন্ড সুবিধা দেয়া হয়। আর এই বন্ড সুবিধা পাওয়া মানে তাদের উপর ট্যাক্স হবে না। তবে আমি ব্যবসায়ীদের বলেছি, আপনারা যে সকল ফার্নিচার দেশের বাজারে বিক্রি করবেন তার উপর তো ট্যাক্স দিতে হবে। এ বিষয়ে তারা রাজি হয়েছেন, তারা সেটা দিবেন।
দেশের ফার্নিচার শিল্পের প্রশংসা করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ফার্নিচার শিল্পে আমাদের তত বেশি দক্ষ কারিগর তৈরি না হলেও যে মানের ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা তৈরি করছেন তাতে তাদের অনেক ধন্যবাদ জানাই। গত ১০-১২ বছরের এই শিল্পে একটা বৈপ্লবিক চেঞ্জ হয়ে গেছে। মানের দিক দিয়ে বলেন, সৌন্দর্যের দিকে বলেন, ডিজাইনে দিকেই বলেন না কেন, তারা বিভিন্ন লেভেলের মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ধনী শ্রেণী সহ সবার জন্যই ফার্নিচার তৈরি করছেন। আর এটা খুবই ভালো বিষয়।
বর্তমানে দেশে ফার্নিচার আমদানির কোন প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, একটা সময় দেশের ফার্নিচার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। তবে এখন আমাদের লোকাল কোয়ালিটির ফার্নিচারের মান এবং ডিজাইন এতই উন্নত হয়েছে যে আর বিদেশ থেকে আমদানি করার কোন প্রয়োজন নেই।
ব্যবসায়ীদের ফার্নিচার রপ্তানির বিষয়ে আরো আগ্রহী হবার পরামর্শ দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি আমাদের ফার্নিচারের কোয়ালিটি এত সুন্দর, যেটা বিদেশে পাঠানো দরকার। বিদেশে পাঠাতে পারলে দুইটা উপকার। একটি হল প্রোডাকশনের পরিমাণ বাড়বে, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আর দ্বিতীয় হল রপ্তানির ফলে বৈদেশিক যে ডলার সেটা আমরা পাব। আমি মনে করি বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্পের যে মান, সেটা পৃথিবীর যেকোনো দেশে বিক্রি হবার যোগ্যতা রাখে।
টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশে যে ১৭ কোটি মানুষ আছে তাদের মধ্যে ৪ কোটি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ইউরোপের মানুষের সমান। এই চার কোটি মানুষ কিন্তু দাম দিয়ে ভালো জিনিসপত্র কিনতে পারেন। ব্যবসায়ীদের বলছি, আপনারা মধ্যবিত্তের কথাও স্মরণ রাখবেন। পাশাপাশি আমরা যদি দেশের যদি সার্বিক উন্নয়ন চাই তাহলে কিন্তু কর্মক্ষেত্রেরও চিন্তা করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য আগামী ২০৪০ সালের দেশে মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৮০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার ডলারে করা। যা অস্ট্রেলিয়ার সমান মাথা পিছু আয় হবে।
দেশের রপ্তানিমুখী ফার্নিচারের বিকাশের স্বার্থে, এই আমদানি ‘কর’ যদি শিল্প বান্ধব হত তাহলে উদ্যোক্তাদের আরও বেশি উৎসাহিত হত বলে মনেকরছেন বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি (বিএফইএ) চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য তিনি বলেন, আমরা আশা করব সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। ফার্নিচার শিল্পের ব্যবহৃত বেশিরভাগ কাঁচামাল দেশের বাহির থেকে আমদানি করতে হয়। যেমন হার্ডওয়্যার, লিকার, ফেব্রিক্স সহ আরো অনেক কিছু দেশের বাহির থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ দেশে এসব কাঁচামাল তৈরির জন্য কোন শিল্পী এখনো গড়ে ওঠেনি। এসব জিনিস দেশের বাহির থেকে আমদানি করতে গেলে বড় অংকের আমদানি ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি এবং রেগুলেটরি ডিউটি দিতে হয়।
বিএফইএ চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, বিশ্ব বাজারে ফার্নিচার শিল্পের যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল, তার সামান্য পরিমাণে বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ২০২২ সালে গ্লোবাল ফার্নিচার মার্কেটের সাইজ ছিল ৫৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের এই মার্কেটে সাইজ ধারণা করা হয় ৬৫০ বিলিয়ন পার্কিং ডলার। বিগত কয়েক বছরের বিশ্ব বাজারে ফার্নিচার ব্যবহারে ট্রেন্ড দেখলে বুঝা যায় যে, ফার্নিচার মার্কেট দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। ২১-২২ সালে আমাদের ফার্নিচার রপ্তানির পরিমান ছিল ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পূর্ববর্তী বছর তুলনায় ৩৯ ভাগ বেশি।
বিএফইএ চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে ফার্নিচার রপ্তানি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইনসহ ইউদেশ সমূহ অন্যতম।
দেশের ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের মেক্সিমাম সেল ও মিনিমাম প্রফিট করার পরামর্শ দিয়ে আরো বেশি রপ্তানি মুখী হবার আহবান জানিয়েছেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা লোকাল মার্কেটিং বেশি করে থাকে। তবে নানা জটিলতায় হয়তোবা তারা বিদেশে রপ্তানি করতে চায় না। তবে আমি মনে করি এখন সময় এসেছে ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা লোকাল মার্কেটের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির দিকে আরো বেশি মনোযোগী হবেন। কারণ আমাদের এখন রপ্তানি হিসেবে ডলার দরকার। ব্যবসায়ীদের বলবো, আপনারা লোকাল মার্কেটের জন্য সেল বেশি করেন, কিন্তু প্রফিট কমিয়ে করে। প্রফেট যদি কম করেন তাহলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বাংলাদেশের (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ.এইচ.এম আহসান, এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, এফবিসিসিআই এর (বিএফইএ) সভাপতি ড. কে এম আকতারুজ্জামান, বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব মো ইলিয়াস সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক এ করিম মজুমদার, বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির আহবায়ক শেখ আব্দুল আউয়াল প্রমূখ।
মন্তব্য করুন: