প্রকাশিত:
২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৩২
পেশায় নিপা (ছদ্মনাম) সেবিকা, বিয়ে হয়েছে ছয় মাসও হয়নি। এর ভেতরেই সে হাঁপিয়ে উঠেছে। জীবনসঙ্গী সাজ্জাদ (ছদ্মনাম) প্রতিদিনই বাইরে বিরিয়ানি বা তেহারি কিছু একটা খাবেই। বাসার রান্না নাকি ভালো লাগে না (তাহলে নিজে রান্না করুক, তা-ও করবে না)। চাকরিতে দুই দিন যাবে, তো তিন দিন যাবে না। এসব করপোরেট চাকরি নাকি তাঁর জন্য না (তাহলে আয়ের জন্য পছন্দের কিছু করুক, সেটাও করবে না)। যা ইচ্ছা তা-ই করবে! অল্পতেই রাগ হয়ে যায়। কিসে যে রাগ হয়, বোঝা মুশকিল! স্ত্রীর টাকায় ঘুরে বেড়াবে, দুই হাতে যা মন চায় কিনবে, আবার সুযোগ পেলেই নিপার চাকরিতে বাগড়া। হাসপাতালে গেলেই ফোন, ‘আজ কখন ফিরবে? তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো। কেন নাইট ডিউটি করতে হবে? অন্যরা করুক, তোমার করার দরকার নেই।’ আত্মীয়স্বজনের অনেকেই বলতে শুরু করেছে, ‘ছেলেটা কেবল গায়ে-গতরেই বড় হয়েছে! বুদ্ধিতে এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছে।’
আপনার জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কি ওপরের কোনো একটা লক্ষণ মিলে যায়? নিজের আবেগ-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, টাকাপয়সা হিসাব করে খরচ করতে না পারা, চাপ সামলে চলতে না পারা, সমালোচনা নিতে না পারা, অবুঝ। এককথায় বয়সের সঙ্গে পরিণত আচরণ না করার এসব লক্ষণ মানে তিনি—ম্যান-চাইল্ড। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হলেও আচরণ শিশুদের মতো। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের সমাজে বসবাসকারী পুরুষদের মধ্যে অনেকেই ‘ম্যান-চাইল্ড’। বাবা-মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ, অস্বাভাবিক ছেলেবেলা, কোনো ঘটনার ট্রমা, অতিরিক্ত আহ্লাদে বড় হওয়া, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা না নেওয়া—এ রকম নানা কারণ এ জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের পুরুষদের মাঝে কি ম্যান-চাইল্ডের সংখ্যা বেশি?
অস্ট্রেলীয় কাউন্সেলিং ফার্ম ‘পাওয়ার অব চেঞ্জ’-এর গবেষণামতে, আমাদের দেশের পুরুষদের অপরিণত আচরণের অন্যতম কারণ হলো বেড়ে ওঠার সময়ে ছেলেশিশু হিসেবে অধিক সুবিধা পাওয়া, ছেলে–মেয়ের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়া, মায়ের অনিরাপত্তাবোধ থেকে ছেলেকে একপক্ষীয় অনৈতিক সমর্থন ইত্যাদি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষের মানসিক পরিপক্বতার বিকাশ যেভাবে হওয়ার কথা, সেটা বাধাগ্রস্ত হয়। কীভাবে? জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল বলেন, ‘বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে শত শত বছর ধরে ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। ছেলেশিশুরা খাবার, খেলাধুলা, আচরণ সবখানেই বেশি সুবিধা পেয়েছে। শাসন করা হয়নি। ফলে তাদের ভেতরে সবকিছুই ফর গ্রান্টেড হিসেবে নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে নিজেদের সমালোচনা তারা নিতে পারে না। যা মন চায়, তাই করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। অন্যদিকে কন্যাশিশুদের ভেতর বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার একটা মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে সব পরিবেশেই তারা সহজে মানিয়ে নিতে পারে। এমনকি দুর্যোগেও তাদের টিকে থাকার প্রবণতা বেশি।’ যদিও এই মনোরোগ চিকিৎসক জোর দিয়ে বলেন, বাবা-মায়েরা যখন একজন আরেকজনকে ছোট করে কথা বলে, শিশুমনে সেটা যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আর দ্বিধার সৃষ্টি করে, সেখান থেকে পরে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও আবেগপ্রবণ বৃদ্ধি’ ভালোভাবে হয় না। ফলে তার ভেতরে ম্যান-চাইল্ড আচরণ দেখা যেতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সঙ্গী একজন ম্যানচাইল্ড?
১. বেশির ভাগ সময়ে বয়সের তুলনায় অপরিণত আচরণ করছে।
২. ‘চাপ’ সামলাতে পারে না।
৩. দায়িত্ব নিতে পারে না। নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপাতে ওস্তাদ।
৪. নিজের আবেগ ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না।
৫. সমালোচনা নিতে পারে না।
৬. হুট করে রেগে যায়। মাঝেমধ্যে রাগের সঠিক কারণও বোঝা যায় না। রাগের মাথায় ভাঙচুরও করতে পারে।
৭. পরিস্থিতি বুঝে মানিয়ে চলতে পারে না। পরিবার, শিশু, স্বাস্থ্য যেকোনো বিষয়েই কম সচেতন।
৮. নেশায় আসক্ত হতে পারে।
৯. পেশাগত জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবনা নেই। কোনো কারণ ছাড়াই বারবার চাকরি বদলায়।
১০. ঘরের কাজ যেমন রান্নাবান্না, বাগান করা, কাপড় পরিষ্কার করা, ইস্তিরি করা, গুছিয়ে রাখা—এসবের কিছুই সে করে না। নিজের কোনো জিনিস ঠিকমতো গুছিয়ে রাখে না।
১১. সারা দিন ভিডিও গেম খেলেও কাটাতে পারে।
১২. ধার করে। শখের বশে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনে।
১২. তার বন্ধুরাও অনেকটা তার মতো!
‘ম্যান-চাইল্ড’ জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেবেন?
মানসিক স্বাস্থ্যসেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’র হেড অব মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম ও প্রধান সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর কাজী রুমানা হক জানান, প্রথমেই মনে রাখতে হবে, যিনি ‘ম্যান-চাইল্ড’ আচরণ করছেন, তিনি নিজেই একজন ভিকটিম। তিনি যে ‘ইমোশনালি ভালনারেবল’, এর কারণ, তাঁকে ছোটবেলায় কাঁদতে শেখানো হয়নি। বন্ধুমহলে তাঁরা বিশ্বরাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, খেলা নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু নিজের মানসিক বিপর্যয় নিয়ে কথা বলেন না। নিজেকে প্রকাশ না করতে করতে একটা সময় সেটা গিয়ে ‘ম্যান-চাইল্ড’-এর রূপ নেয়।
জীবনসঙ্গী ম্যান-চাইল্ড হলে কীভাবে মানিয়ে নেবেন, এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন কাজী রুমানা হক ও ডা. আহমেদ হেলাল।
১. প্রথমত, ধৈর্য, ধৈর্য, ধৈর্য! ধৈর্য আপনাকে ধরতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সহানুভূতিশীল হোন। উত্তেজনা প্রশমন করুন। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করুন। হুট করে কোনো পরিবর্তন আশা করবেন না। আপনার সঙ্গীকে সময় দিন।
২. যতটা সম্ভব আপনার জীবনসঙ্গীর ‘ম্যান-চাইল্ড’ আচরণে প্রভাবিত হবেন না। নিজেদের সম্পর্কের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে দেবেন না।
৩. নিজের কাজ নিজে করুন। নিজের দায়িত্ব নিন। ইতিবাচক মনোভাব রাখুন। আপনার ঘরের শিশুর মতোই জীবনসঙ্গীর সামনেও নিজেকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরুন। তিনি যেন আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন।
৪. কোনোভাবেই রাগ করে, চিৎকার করে আপনার সঙ্গীর আচরণ বদলাতে পারবেন না। হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রাথমিকভাবে আপনার নিজের আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনি আপনার জীবনসঙ্গীর প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে পারেন।
৫. ঠান্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে বোঝান। ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন। আত্মবিশ্বাস রাখুন, আপনি পারবেন। মনে রাখবেন, কেউ পারলে সেটা আপনিই।
৬. তাঁকে অনুভূতি প্রকাশে অনুপ্রাণিত করুন। মন খুলে গল্প করুন। পরে সঙ্গীকে কখনোই আপনাকে বলা কোনো কথার জন্য খোঁটা দেবেন না। সঙ্গীকে ছোট করে কথা বলবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করে সঙ্গীর বলা কোনো গোপন কথা, কোনো অবস্থাতেই তাঁর অনুমতি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
৭. প্রয়োজনে পেশাদারের সাহায্য নিন। ‘কাপল কাউন্সেলিং’ করান।
৮. আপনার শিশুদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করবেন না। তাদের সামনে কেউ কাউকে ছোট করে কথা বলবেন না। তাদের মনের ওপর চাপ হয়, এমন কিছুই করবেন না। সাবলীলভাবে তাদের অনুভূতি প্রকাশে অনুপ্রাণিত করুন। ছেলে-মেয়েনির্বিশেষে ঘরের কাজ শেখান। সৃজনশীল কাজে উদ্দীপ্ত করুন। স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করুন।
মন্তব্য করুন: