প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫৪
দেশের সরকারি প্রকল্পগুলোতে চীনা ঠিকাদারদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। শুধু চীনা ঋণের প্রকল্প নয়, দেশি ও অন্যান্য দেশের প্রকল্পের কাজও পাচ্ছেন চীনা ঠিকাদারেরা। তাঁদের খরচের প্রাথমিক অংশ জোগাতে চীন থেকে অর্থ আসা বেড়েছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাতে ধাক্কা লেগেছে। অর্থ আনা কমিয়ে দিয়েছেন ঠিকাদারেরা। যদিও চীনা ঠিকাদারদের বেশ কিছু বড় প্রকল্প ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
চীনা ঠিকাদারদের হিসাব আছে এমন ব্যাংকগুলো থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। চীনাদের সহায়তা দিতে ইস্টার্ণ, ইউসিবিসহ কয়েকটি ব্যাংক পৃথক ডেস্ক চালু করেছে। আবার এর বাইরে কোনো কোনো ব্যাংক চীনা নাগরিকদের দিয়ে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে বিদেশিরা কাজ কমিয়ে দেন। সরকার নিজেও খরচ কমিয়ে দিয়েছে। এসব কারণে বিদেশ থেকে ঠিকাদারদের অর্থ আসা কমে গেছে।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
চীন থেকে আমদানি বেশি, রপ্তানি ও বিনিয়োগ কম
সাধারণত সরকার কোনো প্রকল্প করার আগে ঠিকাদারদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান (ইওআই) করে। যে ঠিকাদার কাজ পায়, তাকে সেই প্রকল্প খরচের ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত দেশে আনার শর্ত দেওয়া হয়, যা তাদের বেতন, মজুরি ও তাৎক্ষণিক ব্যয় হিসেবে খরচ হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের কাঁচামাল কেনার জন্য যে ব্যয় হয়, তারও একটি অংশ ঠিকাদারদের নিজ দেশ থেকে আনতে হয়। এসব শর্ত দরপত্রের মধ্যে যুক্ত থাকে। সরকার কয়েক দফায় প্রকল্প খরচ পরিশোধ করে।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, অনেক বড় প্রকল্প শেষ হয়ে এসেছে। আবার যেসব প্রকল্প চলমান, নির্বাচনের কারণে সেগুলোর নিয়মিত কাজ ছাড়া বড় কেনাকাটা ও সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। এসব কারণে অর্থ আসা কমে যেতে পারে। প্রকল্পগুলোর গতি কমে এসেছে। নির্বাচনের পর আবার সব স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে।
জানা যায়, বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংক চীনা ঠিকাদারদের ৭০ শতাংশ ব্যাংকিং সুবিধা দেয়। ব্যাংকটির মাধ্যমে চীনা ঠিকাদারদের ডলার আসে, যা টাকায় গ্রহণ করেন ঠিকাদারদের প্রতিনিধিরা। ব্যাংকটি সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতেও ডলার-সংকটে পড়েনি; কারণ, চীন থেকে ঠিকাদারদের প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি ডলার আসে। পাশাপাশি ব্যাংকটির রপ্তানি আয়ও ভালো। এ ছাড়া সারা দেশে নেটওয়ার্ক সুবিধার কারণে প্রবাসী আয়ও পায় ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির নথিপত্র বলছে, চলতি বছরের আগস্ট-অক্টোবর সময়ে চীনা ঠিকাদারদের ১১ কোটি ডলার এসেছে; গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩ কোটি ডলার। আগের কোনো ত্রৈমাসিকে তা ১৫ কোটিও ছাড়িয়েছিল, এখন যা কমে এসেছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে ঠিকাদারেরা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারও অর্থ ছাড় কমিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রকল্পগুলোর গতি কমেছে। পাশাপাশি কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। চীনারা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নতুন সরকার গঠনের পর তারা কাজের বিষয়ে মনোযোগ বাড়াবেন। একই রকম তথ্য দেন আরও দুটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) টাকা খরচ কমে গেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এডিপি বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ২১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার সাড়ে ৭ শতাংশ। আগের ছয় অর্থবছরের কোনোবারই প্রথম তিন মাসে এডিপি ৮ শতাংশের কম বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সব সময়ই পাশে আছে চীন: রাষ্ট্রদূত
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে বিদেশিরা কাজ কমিয়ে দেন। সরকার নিজেও খরচ কমিয়ে দিয়েছে। এসব কারণে বিদেশ থেকে ঠিকাদারদের অর্থ আসা কমে গেছে। এভাবে চললে প্রকল্পগুলোর সময় ও খরচ—দুটোই বেড়ে যাবে। এর চাপ নিতে হবে দেশের জনগণকে। এসব নিয়ে আমলাদের ভ্রুক্ষেপ নেই, চাকরির মেয়াদ শেষে তাঁদের আর্থিক সুবিধা পেলেই হলো।
জানা যায়, সড়ক, সেতু, বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটিসহ বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ১০টি বড় প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে কাজ করছে ২০টি বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠানই চীনের। পায়রা সেতু, ঢাকা বিআরটি, টাঙ্গাইল-রংপুর চার লেন মহাসড়ক, ক্রস বর্ডার সড়ক উন্নয়ন, শীতলক্ষ্যা সেতুসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনের এসব প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল (ঢাকা-মাওয়া-যশোর), কর্ণফুলী টানেল ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, দাসেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনকেন্দ্রও চালু হয়েছে। এ ছাড়া চীনা ঠিকাদারদের প্রকল্পের মধ্যে আরও আছে ফোর টিয়ার ডেটা সেন্টার, শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও ডিজিটাল সরকার প্রকল্প, মোবাইল অপারেটরের একচেটিয়া নেটওয়ার্কসহ আরও কয়েকটি। এর মধ্যে কিছু চালু হয়েছে; কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে।
মন্তব্য করুন: