প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৫২
বাংলায় যাকে ‘শতবর্ষী’ বলা হয়, সে রকম মানুষ সংখ্যায় এখনো নগণ্য। ৭৮৮ কোটি মানুষের বিশ্বে ৫-৬ লাখের মতো হবেন। দেশগুলোর ভেতর যুক্তরাষ্ট্রে শতবর্ষী মানুষ বেশি, ৯০ হাজারের মতো। ৩৩ কোটি মানুষের দেশে ৯০ হাজারের একজন হতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেই অর্থে হেনরি কিসিঞ্জারকে ভাগ্যবান বলতে হয়।
গত মে মাসে কিসিঞ্জারের ১০০ বছর হলো। আমেরিকার কুলীন সমাজে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে এ উপলক্ষে। সেই উদ্যাপন ও উচ্ছ্বাসের রেশ এখনো শেষ হয়নি। এর ভেতর মৃদুস্বরে এ প্রশ্নও উঠেছে—বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাস হেনরি কিসিঞ্জারকে কীভাবে মনে রাখবে? হেনরি কিসিঞ্জারকে নিয়ে আমেরিকার কি গর্ব করা উচিত? বিশেষ করে যখন তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বহু দেশে বিস্তর অন্যায় ভূমিকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত রয়েছে!
কেবল বয়সের মানদণ্ডে নয়, অর্থ-বিত্তের হিসাবেও কিসিঞ্জার সৌভাগ্যবান রাজনীতিবিদ। একসময় জার্মানি থেকে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসা এই ইহুদি ধর্মালম্বীর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ রয়েছে এখন।
একজন বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করলেও কিসিঞ্জারের খ্যাতি মূলত কূটনীতিবিদ হিসেবে। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪০ মাস তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এর ভেতর আবার ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী ছিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ছিলেন বৈদেশিক গোয়েন্দা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। ২০০১ থেকে ২০২০, এই দুই দশক প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এ রকম সব দায়িত্ব মিলে প্রায় ৫০ বছরের কূটনীতিক জীবন তাঁর।
দারুণ এক কর্মবীর বলতে হয় কিসিঞ্জারকে। এখনো তিনি সক্রিয় কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটের সভাপতি ছাড়া আরও কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শদাতা হিসেবে। তাঁর প্রাপ্তির তালিকা ঈর্ষণীয়। নোবেল শান্তি পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘মেডেল অব ফ্রিডম’ পেয়েছেন।
জন্মগতভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নন—কিন্তু দেশটি তার সেরা সন্তানদের একজন বিবেচনা করে কিসিঞ্জারকে। কিন্তু এমন কি হতে পারে যে কিসিঞ্জারকে ‘মেডেল অব ফ্রিডম’ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিব্রত হবে কোনো দিন? এ প্রশ্নও ভাবাচ্ছে কাউকে কাউকে। কারণ, দীর্ঘ জীবন ও বিপুল প্রাপ্তির পাশাপাশি কিসিঞ্জারকে নিয়ে বিতর্কও কম নয়।
কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের কেউ হলে আমেরিকার মূল ধারার সংবাদমাধ্যম হয়তো বহুকাল আগে থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁর বিচার চাইত। যদিও এটা এককভাবে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বসমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা যে এ রকম কথিত ‘সফল’ কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের আজও তাঁদের কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না। চলতি বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যেই সেই দুর্বলতা রয়ে গেছে।
কিসিঞ্জারের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথাই ধরা যাক। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বিতর্কিত ও নিন্দিত ঘোষণা। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে মিলে যে মানুষ ভিয়েতনামকে ধ্বংসে মেতে ছিলেন, তাঁকেই ১৯৭৩ সালে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়ে।
উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে মিলে কিসিঞ্জার এই পুরস্কার পান। এই ‘শান্তি পুরস্কার’ ঘোষণার পরও ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হতে দুই বছর লেগেছে। কিসিঞ্জারের জন্য এটা বিব্রতকর ছিল, যখন অপর পুরস্কার প্রাপক লি থো এটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীকালে নোবেল কমিটির পুরোনো দলিল অবমুক্তির পর দেখা যায়, কিসিঞ্জার নিজেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে ১৯৭৫ সালের মে মাসে যুদ্ধ শেষে এই পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নোবেল কমিটি তাতে রাজি হয়নি।
কিসিঞ্জারের কুখ্যাতি কেবল ভিয়েতনামকে ঘিরেই ছিল না। সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটান তিনি চিলিতে। ১৯৭৩ সালে সেখানকার জনপ্রিয় সালভাদর আলেন্দে সরকারকে উৎখাতে জেনারেলদের মদদ দিয়ে কিসিঞ্জার তাঁর কূটনীতিক জীবনকে প্রথম মোটা দাগে বিতর্কের মুখে ফেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বার্থ’ রক্ষা করতে গিয়ে সেখানে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়া হয়। আলেন্দে উৎখাতের আট দিন পর সিআইএ পরিচালকের সঙ্গে কিসিঞ্জারের টেলিফোন আলাপ থেকে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে অনেক বিশ্বাসযোগ্য ইঙ্গিত বিশ্ববাসীর সামনে হাজির আছে। কেবল আলেন্দে নন, তাঁর কয়েক হাজার সমর্থককেও তখন হত্যা করে জেনারেল পিনেশোর বাহিনী।
কিসিঞ্জার লাওস, কম্বোডিয়া এবং পূর্ব তিমুরবাসীর কাছেও নিন্দিত তাঁদের পূর্ব পুরুষদের রক্ত ঝরানোর জন্য। ১৯৬৯ সালে কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের গেরিলাদের গোপন ঘাঁটি ধ্বংস করতে গিয়ে লাগাতার বোমা ফেলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। অথচ সে সময় কম্বোডিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিবাদ ছিল না। মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিছেন, সামান্তা পাওয়ার প্রমুখের পুরোনো দাবি রয়েছে, কম্বোডিয়া অভিযানে ৩ হাজার ৮৭৫ দফা বোমা ফেলা হয় কিসিঞ্জারের সরাসরি অনুমোদনে।
বাংলাদেশ যুদ্ধকালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিও কিসিঞ্জারের মদদ বেশ খোলামেলা ব্যাপার ছিল। আর্জেন্টিনায় ১৯৭৬ সালে ডানপন্থী জেনারেলদের চোরাগোপ্তা বামপন্থী নিধনেও তাঁর সম্মতি ছিল।
২০১৪ সালে এ বিষয়ে বিপুল দলিলপত্র অবমুক্ত হয়েছে, যাতে আর্জেন্টিনার ওই ‘নোংরা যুদ্ধে’ কিসিঞ্জারের উৎসাহের বিবরণ মেলে। তিনি সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিজার অগাস্টো গুজ্জেত্তিকে ‘সমস্যাগুলো পরিষ্কারের কাজ দ্রুত করতে’ অনুরোধ জানাচ্ছিলেন।
একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোকে ১৯৭৫ সালে মদদ দেওয়া হয় পূর্ব তিমুরে অভিযান চালাতে, যাতে প্রায় এক লাখ বেসামরিক মানুষ মারা যায়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক গ্রেগ গ্রানদিন ‘কিসিঞ্জারস শ্যাডো’ গ্রন্থে (২০১৫) বিস্তারিত দেখিয়েছেন যে কীভাবে বিভিন্ন দেশে কয়েক লাখ মানুষের নিহত-আহত হওয়ায় কিসিঞ্জারের দায় আছে। যার মধ্যে যুক্ত হতে পারে ভারতের ভূপালে ইউনিয়ন কার্বাইড দুর্ঘটনায় মৃত মানুষেরাও। এই কারখানা স্থাপনে ভারত সরকারের ওপর কিসিঞ্জার প্রভাব খাটিয়েছিলেন।
‘বিশ্ব পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে রাখতে’ নীতিনির্ধারক হিসেবে কিসিঞ্জার যে তত্ত্ব হাজির করেছিলেন তা হলো, ওয়াশিংটনকে ‘নৈতিক ও আদর্শিক বিবেচনাগুলো কখনো কখনো অবজ্ঞা করতে হবে।’ এটা করতে গিয়ে রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কাজের সময় কিসিঞ্জার অনেক দেশে মানবাধিকার দলনে ভূমিকা রেখেছেন বলে বহু নির্ভরযোগ্য লেখাজোখা রয়েছে এখন বিশ্বজুড়ে। খোদ আমেরিকায় কোডপিঙ্কসহ অনেক যুদ্ধবিরোধী সংগঠন বহুবার তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কোথাও কৃতকর্মের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জবাবদিহিতা বা বিচারের মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে।
এবার কিসিঞ্জারের যখন ১০০ বছর পূর্তি হচ্ছিল, তখন সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের একালের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে। সেখানে কিসিঞ্জারকে নিয়ে অনেক প্রশংসামূলক লেখা বের হয়। ২৭ মে রাষ্ট্রীয় মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে কিসিঞ্জারকে নিয়ে যে সম্পাদকীয় লেখা হয়, সেখানে ছত্রে ছত্রে ছিল তাঁর প্রশংসা।
কিসিঞ্জারের কূটনীতিক জীবনের এক বড় দাবি, তিনিই যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের নির্মাতা। নিক্সনের আমলে এই সম্পর্কের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। চীনও এই অবদানের কথা স্বীকার করে। এমনকি এখনো, যখন তাদের কোনো না কোনো নেতা প্রতিদিন ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে ক্রুদ্ধ বিবৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ যুদ্ধের ফাঁকেই পাকিস্তানের সহায়তায় কিসিঞ্জার চীন অধ্যায়ের সূচনা করেন ১৯৭১ সালে গোপনে চীন সফরে যেয়ে।
কিসিঞ্জারের চীননীতির ফল হিসেবে চীন ও আমেরিকা উভয়ই দুটো বিশাল বাজার পেয়েছে। উপরন্তু চীন-রাশিয়া সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত করা গিয়েছিল তাতে, যা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য ধ্বংসাত্মক কোন্দলের কারণ হয়। অথচ এখন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলার আওয়াজ তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কুলীন সমাজ গত দুই-তিন মাস যখন কিসিঞ্জারের জন্মদিন উদযাপন করে চলেছে, তখন এটা তারা বেশ এড়িয়ে যাচ্ছেন, পুঁজিতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী বর্তমান চীন তাদের বাজার দ্বারাই পাঁচ দশকে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে এ জায়গায় এল।
বোঝা যাচ্ছে, আপাতত কিসিঞ্জারের কোনো সমালোচনা তারা আমলে নিতে রাজি নেই। সবকিছুর বাইরে তাদের অস্বস্তি এই শতবর্ষীর মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে। কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের কেউ হলে আমেরিকার মূল ধারার সংবাদমাধ্যম হয়তো বহুকাল আগে থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁর বিচার চাইত। যদিও এটা এককভাবে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বসমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা যে এ রকম কথিত ‘সফল’ কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের আজও তাঁদের কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না। চলতি বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যেই সেই দুর্বলতা রয়ে গেছে।
তবে বিশ্ব নেতৃত্বের এ রকম গাফিলতির পরও কূটনীতির অঙ্গনকে মূল্যবোধের বধ্যভূমিতে পরিণত করার জন্য ড. কের কথা মনে রাখবে চিলি, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া, লাওস, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বহু দেশের মানুষ। তাঁরা হয়তো এ রকম মেনে নিতে চাইবেন না যে গত ১০০ বছরকে ‘কিসিঞ্জার সেঞ্চুরি’ বলা যায়, যেমনটা বলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রচারমাধ্যম এবং আশ্চর্যজনকভাবে চীনও।
মন্তব্য করুন: