প্রকাশিত:
৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:৫৩
ভারতে ৩০ নভেম্বর একসঙ্গে পাঁচ রাজ্যের ভোট শেষ হলো। রাজ্যগুলো হলো রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও মিজোরাম। ইতিমধ্যে ভোটের ফলাফলও বের হয়েছে চার রাজ্যে।
ভোট হয়েছিল বিধানসভার (প্রাদেশিক পরিষদ) প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য। কিন্তু এই নির্বাচনের ফল থেকে অনেকে ভারতের আগামী রাজনীতির ইঙ্গিতগুলোও শনাক্ত করতে চাইছেন। এখানে প্রশ্নোত্তরে সেই ইঙ্গিত খোঁজার চেষ্টা হয়েছে মূলত পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে।
সর্বশেষ এই নির্বাচন জাতীয় বিবেচনায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আর পাঁচ মাস পর ভারতে লোকসভার প্রতিনিধি বাছাই শুরু হবে। লোকসভার আসন ৫৪৩। যে পাঁচ রাজ্যে ভোট হলো, তাতে লোকসভার আসন ৮৩টি। এই হিসাব দেখিয়ে সর্বশেষ নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের ১৫ শতাংশের সমান গুরুত্বপূর্ণ বলছেন অনেকে। যদিও ভোট হয়েছে বিধানসভার জন্য। যে পাঁচ রাজ্যে ভোট হলো, তাতে লোকসভার আসন হলো রাজস্থানে ২৫, তেলেঙ্গানায় ১৭, মধ্যপ্রদেশে ২৯, ছত্তিশগড়ে ১১ ও মিজোরামে ১। অন্যদিকে এই পাঁচ রাজ্যের সব বিধানসভা মিলে আসন হলো ৬৭৯টি (তবে ১টি আসনে প্রার্থী মারা যাওয়ায় ভোট স্থগিত হয়েছে)।
অন্যভাবে বললে, এই রাজ্যগুলোতে লোকসভা নির্বাচনে তার বাড়তি খারাপ করার কিছু নেই তেমন। কিন্তু এবার উঠে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ আছে কি না? ভোটের পুরো চিত্র পেলে সেটা স্পষ্ট করে বলা যাবে। কারণ, এখনো কোন দল কত শতাংশ ভোট পেল, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে আপাত এটা বলা যায়, বিজেপি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মোকাবিলায় অনেকটাই ভয়মুক্ত হতে পারে।
সমগ্র ভারতে সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে বিধানসভাগুলোর আসন ৪ হাজার ১২৩। এর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরে ‘প্রেসিডেন্টের শাসন’ চলছে এখন। সেখানকার বিধানসভাকে বাদ দিয়ে (৯০ আসন) হিসাব করলে নভেম্বরে ভোট হওয়া পাঁচ রাজ্যে ছিল সমগ্র ভারতের ১৭ শতাংশ বিধানসভা আসন।
ওপরের দুই ধরনের উপাত্ত একসঙ্গে নিয়ে অনেকে বলছেন, পাঁচ রাজ্যের সর্বশেষ এই নির্বাচন একদিকে ১৭ শতাংশ বিধানসভা আসনের ভোট হলেও একে অন্য বিবেচনায় ১৫ শতাংশ লোকসভা আসনের ভোটও বলা যায়। এই দাবি কতটা সঠিক, সেটা লেখার একদম শেষে আমরা খতিয়ে দেখেছি। তবে ভারতে প্রায় সবাই এই নির্বাচনকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সীমিত আকারের অনুশীলন হিসেবে নিয়েছেন। সেভাবেই এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে।
নির্বাচনে বিজেপি কতটা ভালো করল?
এই নির্বাচনে পাঁচ রাজ্যের যে ৬৭৯টি আসনে ভোট হয়েছে, গত নির্বাচনে তার ১৯৯টি পেয়েছিল বিজেপি। এই পাঁচ রাজ্যের ভোটে গত নির্বাচনে বিজেপি কোথাও কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলগুলোর চেয়ে বেশি আসন পায়নি। এবার সেই পরিস্থিতি বদলে গেল আমূলভাবে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়—সর্বত্র বিজেপি অন্যদের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে এবং আগের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে।
গতবার তারা রাজস্থানে পেয়েছিল ৭৩টি আসন, এবার ১১২। ছত্তিশগড়ে গতবারের ১৫টির জায়গায় এবার পেল ৫৫টি। মধ্যপ্রদেশে ১০৯টির জায়গায় পেয়েছে ১৬১টি। তেলেঙ্গানায় গতবার পেয়েছিল ১টি, এবার পেল ৯টি।
গতবার যেখানে তারা রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম মিলে ২০০ আসনের নিচে ছিল এবার কেবল প্রথম চারটিতে তারা পেল ৩৩৭; অর্থাৎ আসনের হিসাবে বিজেপি অনেক এগিয়েছে। সর্বত্র তাদের আসন বিপুলভাবে বেড়েছে। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন যদি তাদের ভাষায় ২০২৪-এর সেমিফাইনাল হয়, তবে তাতে তারা ‘বিজয়ী’। এখন কেবল মিজোরামের ফলের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
এই নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থা কী দাঁড়াল?
২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস আলোচ্য পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে ৩০৬টি আসন পায়; অর্থাৎ তখন বিজেপির চেয়ে তারা ১০৭টি আসন বেশি পেয়েছিল। তখন রাজস্থানে তারা পায় ১০০ আসন, ছত্তিশগড়ে ৬৮, মধ্যপ্রদেশে ১১৪, তেলেঙ্গানায় ১৯ ও মিজোরামে ৫। এবার তারা রাজস্থানে পেল ৭২, ছত্তিশগড়ে ৩২, মধ্যপ্রদেশে ৬৬ ও তেলেঙ্গানায় ৬৪। তেলেঙ্গানা ছাড়া ইতিমধ্যে ফল ঘোষিত বাকি তিন রাজ্যে কংগ্রেসের আসন বড় ব্যবধানে কমেছে।
এই চার রাজ্যে তারা গতবার পেয়েছিল ৩০১টি আসন। এবার পেল ২৩৪টি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আসনের হিসাবে কংগ্রেস খারাপ করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হলো লোকসভা নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে তাদের খারাপ করা। তবে তারা তেলেঙ্গানায় গতবারের চেয়ে ভালো করায় রাহুল গান্ধীর কিছুটা মুখ রক্ষা হলো। সামগ্রিক হিসাবে সর্বশেষ এই নির্বাচনী যুদ্ধে কংগ্রেস বিজেপির কাছে ‘ধরাশায়ী’ না হলেও ‘হেরেছে’।
আঞ্চলিক দলগুলো কি এই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারল?
ভারতে নির্বাচনী রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলো বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ‘তৃতীয় শক্তি’। সর্বশেষ পাঁচ রাজ্যের ভোটের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল অন্তত দুটি আঞ্চলিক দল এই নির্বাচনে দুটি রাজ্যে বড় ফ্যাক্টর ছিল। এতে ভবিষ্যতে ভারতে আঞ্চলিক দলগুলোর কী পরিণতি হতে যাচ্ছে, সেটাও খানিক আঁচ পাওয়া গেল। পাঁচ রাজ্যের মধ্যে মিজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফ এবং তেলেঙ্গানায় বিআরএস বা ভারত রাষ্ট্র সমিতি ক্ষমতায় ছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে এমএনএফ মিজোরামের ৪০ সদস্যের বিধানসভায় ২৬টি আসন পায়। সোমবার বোঝা যাবে তারা নতুন নির্বাচনে কেমন করেছে।
অন্যদিকে ভারত রাষ্ট্র সমিতি (তখন নাম ছিল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি) ১১৯ আসনের তেলেঙ্গানা বিধানসভায় গতবার পায় ৮৮টি আসন। এবার পেয়েছে ৪১টি; অর্থাৎ গতবারের চেয়ে ৪৭ আসন কম। তেলেঙ্গানায় আসাদুদ্দিন ওয়াইসির ‘মিম’ নামে পরিচিত মুসলমানপ্রধান আঞ্চলিক দলটিও এই নির্বাচনে খারাপ করেছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়েও আঞ্চলিক দলগুলো সম্মানজনকভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। রাজস্থানে বহুজন সমাজবাদী দলের গতবারের চারটি আসন কমে এবার দুটি হয়েছে।
এসব দলের খারাপ ফল স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, ভারতের রাজনীতি বিজেপি বনাম কংগ্রেস ধারাতেই আপাতত চলবে। এ অবস্থায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলো একা নির্বাচন না করে বিজেপি ও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার কৌশল নিতে বাধ্য হবে। বিজেপি হয়তো অনেককে আর নিতে পারবে না—সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের জন্য এই প্রবণতা বেশ শুভ।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের জন্য কী বার্তা?
ভারতের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিধানসভা নির্বাচনে লোকসভা নির্বাচনের বার্তা খোঁজা চরম বোকামি হতে পারে। যদিও প্রচারমাধ্যম বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের যোগাযোগ স্থাপন করে দেখাতে এ মুহূর্তে খুব তৎপর; কিন্তু তথ্য-উপাত্ত একদম তা সমর্থন করে না। যেমন আলোচ্য পাঁচ রাজ্যের আগের বিধানসভা নির্বাচনে কোনোটিতে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও লোকসভার নির্বাচনে ব্যাপক ভালো করেছিল।
রাজস্থানে ২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ১০০টি আসন পায়, আর বিজেপি পায় ৭৩টি আসন। অথচ ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনকালে এই রাজ্যে কংগ্রেস একটা আসনও পায়নি। আর বিজেপি পায় ২৪টি আসন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি নির্বাচন হলেও বিধানসভা ও লোকসভার ফলাফলে উল্টো চিত্র দেখা যায়। অন্য রাজ্যের বেলায়ও একই রকম উদাহরণ পাওয়া যায়।
ভারতের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিধানসভা নির্বাচনে লোকসভা নির্বাচনের বার্তা খোঁজা চরম বোকামি হতে পারে।
ভারতের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিধানসভা নির্বাচনে লোকসভা নির্বাচনের বার্তা খোঁজা চরম বোকামি হতে পারে।ছবি : রয়টার্স
মধ্যপ্রদেশে আগের নির্বাচনে বিধানসভায় কংগ্রেস ১১৪টি ও বিজেপি ১০৯টি আসন পাওয়ার পর লোকসভা নির্বাচনকালে দেখা যায়, বিজেপি পেয়েছে ২৮টি ও কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১টি। এ রকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে আসন পায় ৬৮ (বিজেপি মাত্র ১৫)। অথচ কয়েক মাস পরের জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস লোকসভায় আসন পায় ২টি, বিজেপি পায় চার গুণের বেশি, ৯টি।
এ রকম চিত্রের কারণ হলো বিধানসভা নির্বাচনে ভোটাররা যেসব বিবেচনা সামনে রেখে ভোট দেন—জাতীয় নির্বাচনকালে সেসব বিবেচনা না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে, বিজেপি জাতীয় নির্বাচন এলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব এবং ধর্ম ও হিন্দুত্বকে যেভাবে প্রচারে প্রধান বিষয় করে তোলে, কংগ্রেস তার সামনে সুবিধা করতে পারে না।
গত বছর দেশজুড়ে পদযাত্রার মাধ্যমে রাহুল গান্ধী নিজের ভাবমূর্তি কিছুটা শক্তিশালী করতে পেরেছেন বলে কংগ্রেস কর্মীরা দাবি করছেন। কিন্তু সেই দাবির সামান্যই প্রমাণ পাওয়া গেল সর্বশেষ নির্বাচনে।
শুরুতে বলা হয়েছে, ভারতে যে পাঁচ রাজ্যে এখন ভোট হলো, তাতে লোকসভার আসন ৮৩টি। এই আসনগুলোর মধ্যে কংগ্রেস গতবার পেয়েছিল মাত্র ৬টি। গত জাতীয় নির্বাচনে এই পাঁচ রাজ্য তার অন্যতম বধ্যভূমি ছিল।
অন্যভাবে বললে, এই রাজ্যগুলোতে লোকসভা নির্বাচনে তার বাড়তি খারাপ করার কিছু নেই তেমন। কিন্তু এবার উঠে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ আছে কি না? ভোটের পুরো চিত্র পেলে সেটা স্পষ্ট করে বলা যাবে। কারণ, এখনো কোন দল কত শতাংশ ভোট পেল, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে আপাত এটা বলা যায়, বিজেপি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মোকাবিলায় অনেকটাই ভয়মুক্ত হতে পারে।
মন্তব্য করুন: