প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:২৬
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা অন্তত তিন মামলার রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের নাম এসেছে। তিনটি মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি আশরাফুজ্জামান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বিদেশে পলাতক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দেওয়া রায়ের পর ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁদের দেশে ফেরত আনা যায়নি।
স্বাধীনতার পরপর মুঈনুদ্দীন পাকিস্তানে চলে যান এবং এরপর সেখান থেকে লন্ডনে যান। অন্যদিকে আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থাকতেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার শীর্ষ একজন কর্মকর্তা। আশরাফুজ্জামান বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনার ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ও মুঈনুদ্দীন ‘অপারেশন ইনচার্জ’ ছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে এসেছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই দুই পলাতক আসামিকে ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ওই দুজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। নিয়ম ও আইন দিকগুলো পর্যালোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানানো হবে।
একাত্তর সালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ঘটনায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মোট ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালের রায়ে সব কটি প্রমাণিত হয়েছে। ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হলেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ট্রাইবু৵নালের রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি।
ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন, আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকারভাবে বসে থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপরাধের গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিটউর তাপস কান্তি বল বলেন, ‘মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বাদে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের সাজার রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছি।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্র ও মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে আছেন বলে জানা যায়। দুঃখবোধের জায়গা হচ্ছে, ১০ বছরেও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা জরুরি।
মন্তব্য করুন: