প্রকাশিত:
১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩২
যুক্তরাষ্ট্রের টেসলা গাড়ি আমদানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল ছয় বছর আগে। প্রথম আমদানি করা সেই গাড়িটির দাম পড়েছিল ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে শুল্ক–করসহ বন্দর থেকে ছাড়াতে মোট খরচ হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এরপর ছয় বছরে দেশে টেসলাসহ মোট ৭২টি বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি হয়েছে। বেশির ভাগই আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিলাসবহুল এসব গাড়ি বিক্রি হচ্ছে দেড় কোটি থেকে তিন কোটি টাকা। তবে এখনো সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে পড়ে এমন কোনো বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাত হয়নি।
গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে গাড়ির বাজারে জাপানের রিকন্ডিশন্ড, অর্থাৎ ব্যবহৃত গাড়ির ক্রেতাই সবচেয়ে বড়। চলতি বছরে গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি হওয়া মোট গাড়ির মধ্যে জাপান থেকেই আনা হয়েছে ৮৬ শতাংশ। দেশে পুরোনো গাড়ির ক্রেতা বেশি হলেও জাপান থেকে পুরোনো বৈদ্যুতিক গাড়ি আসছে না।
আবার পুরোনো গাড়ি আমদানি করা যায় শুধু জাপান থেকে। এর বাইরে অন্য দেশ থেকে কম দামি নতুন বৈদ্যুতিক গাড়িও আসছে না। এ কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়লেও বাংলাদেশে এটির বাজার বড় হচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বিশ্বজুড়েই দেশে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকারগুলো। বাংলাদেশে এ ধরনের গাড়ি আমদানি শুরুর পাঁচ বছর পর নীতিমালা হয়েছে। চলিত বছরের এপ্রিলে প্রণয়ন করা হয় ‘ইলেকট্রিক মোটরযান নিবন্ধন ও চলাচলসংক্রান্ত নীতিমালা’। ইতিমধ্যে কয়েকটি চার্জিং স্টেশনেরও যাত্রা শুরু হয়েছে।
বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলার–সংকটের কারণে গাড়ি আমদানিতে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এ জন্য সব ধরনের গাড়ির আমদানি কমছে। এখন গাড়ি আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে শতভাগ মার্জিন পরিশোধ করতে হয়। এর ওপর নির্বাচন সামনে রেখে অনিশ্চয়তার কারণে গত কয়েক মাস গাড়ি বিক্রি কমেছে। অনিশ্চয়তা কেটে গেলে আগামী দিনে বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি ও ব্যবহার বাড়বে বলে ধারণা তাদের।
পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার মহাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের সব দেশ বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে প্রণোদনা দিচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়নের এক বছরও হয়নি। অবকাঠামোও এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়ন করা গেলে এই গাড়ির আমদানি ও ব্যবহার বাড়বে।
আনুষ্ঠানিক বিপণনে তিন প্রতিষ্ঠান
আনুষ্ঠানিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টস লিমিটেড, এক্সিকিউটিভ মোটরস লিমিটেড ও র৵ানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড।
দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিপণনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি জার্মানির অডি গাড়ির পরিবেশক। এ বছরের শুরুতে তারা ‘অডি ই-ট্রন’ ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারজাত শুরু করে। এখন পর্যন্ত ৩২টি গাড়ি এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। খালাসের অপেক্ষায় আছে আরও আটটি গাড়ি।
প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ফজলে সামাদ বলেন, ডলার–সংকটে ঋণপত্র খুলতে সমস্যার কারণে বর্তমানে গাড়ি আমদানি কমছে। আবার নির্বাচনের আগে মানুষ বড় খরচ করতে চায় না। তাই বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার কয়েক মাস ধরে স্তিমিত হয়ে আছে। বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার বড় হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, ব্যয় সাশ্রয়ীও। প্রোগ্রেস মোটরস ২০২৬ সালের পর শুধু বৈদ্যুতিক গাড়িই বিপণনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
গত আগস্টে বাংলাদেশের বাজারে প্রথমবারের মতো বিএমডব্লিউর বৈদ্যুতিক গাড়ি এনেছে এক্সিকিউটিভ মোটরস। প্রতিষ্ঠানটি ‘বিএমডব্লিউ আইএক্সথ্রি এম ম্পোর্ট ২০২৩’ এবং ‘বিএমডব্লিউ আই সেভেন ই-ড্রাইভ ফিফটি’—এই দুটি মডেল এনেছে। এর মধ্যে আই সেভেন সিরিজের গাড়িটি এক চার্জে সর্বোচ্চ ৬১১ কিলোমিটার পথ চলতে পারে।
এক্সিকিউটিভ মোটরসের পরিচালক (পরিচালন) আশিক উন নবী বলেন, ‘বিএমডব্লিউউ ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতকরণের মাত্র তিন মাসেই বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি আমরা। গ্রাহকেরা ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। সামনে আমদানি আরও বাড়বে।’
শত বছরের পুরোনো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড মরিস গ্যারেজেস (এমজি)। দেশে এই ব্র্যান্ডের নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ির পরিবেশক র৵ানকন ব্রিটিশ মোটরস লিমিটেড। তারা ২০২১ সালে প্রথম এমজি ব্র্যান্ডের জেডএস মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাত শুরু করে। বর্তমানে এমজি ফোর মডেলের গাড়ি বাজারজাত করছে র্যানকন।
র৵ানকন ব্রিটিশ মোটরসের হেড অব মার্কেটিং ইমতিয়াজ নওশের বলেন, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বিবেচনায় আগামী দিনে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার হিস্যা বাড়বে।
এ ছাড়া ইউরোপিয়ান গাড়ির পরিবেশক ছাড়াও অভি ট্রেডিং, টিবিএইচ কোং, অটো ইম্পোর্টস লিমিটেড, আরপিএম মোটরস, সামিদ অটো ইম্পোর্টসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক গাড়ি এনেছে।
দেশে উৎপাদন মার্চে
আমদানির পাশাপাশি দেশেও বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের কারখানা হয়েছে। এ জন্য চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কারখানাটিতে বৈদ্যুতিক গাড়ির মূল কাঠামো (বডি), ব্যাটারি, মোটর ও চার্জার তৈরি হবে।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবীর বলেন, মিরসরাইয়ের কারখানায় সব ক্যাটাগরির গাড়ি তৈরি হবে। এর মধ্যে সেডান কার, এসইউভি, এমপিভি গাড়ির দাম পড়বে ১২ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সব শ্রেণির ক্রেতাদের হাতের নাগালে থাকবে গাড়ির দাম।
ভবিষ্যৎটা বৈদ্যুতিক গাড়ির
বাংলাদেশে একসময় শতভাগ গাড়িই ছিল জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত। এই তালিকায় ২০০৯ সালে যুক্ত হয় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের সমন্বয়ে চালিত হাইব্রিড গাড়ি। ওই বছর হাইব্রিড গাড়ি আমদানি হয়েছিল দুটি, যা পরের বছর বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টি। শুরুতে এই গাড়ির বাজার হিস্যা ছিল খুবই কম। তবে সরকার হাইব্রিড গাড়িতে প্রণোদনা দেওয়ার পর থেকে এই গাড়ির বাজার দ্রুত বড় হতে থাকে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আমদানি করা মোট গাড়ির ৪৮ শতাংশই হল হাইব্রিড ধরনের।
হাইব্রিড গাড়ি বিপণনের উদাহরণ টেনে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তাদের বাজারও বড় হতে বেশি সময় লাগবে না। কারণ, বৈদ্যুতিক গাড়ি নীতি–সহায়তা প্রণয়ন হয়েছে। চার্জিং স্টেশনসহ অবকাঠামোও তৈরি হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি চলাচলের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মোট গাড়ির ৩০ শতাংশ হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। এটি হলো সরকারের লক্ষ্য। বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকলে এটির বাজার দ্রুত বড় হবে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মন্তব্য করুন: