দেখতে দেখতে জীবন থেকে ফুরিয়ে যেতে চলছে আরও একটি বছর। শুরু হবে নতুন বছরে জীবনের নতুন এক অধ্যায়। আগমনী বর্ষে মুমিনের কাজ কেমন হবে, কোন বিষয়গুলো পালনীয় এবং কোন বিষয়গুলো বর্জনীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়েই সাজিয়ে তুলতে হবে একজন মুমিনের জীবন মেলা।
বিগত বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অনেকের অনেক রকম প্রস্তুতি চলছে। এ ক্ষেত্রে ইমানি চেতনা ইমানদারদের নতুন বছরের আগমন ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে শেখায়। কারণ জীবনকে কাজে লাগানোই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। আর সে জন্য প্রয়োজন ইমানি চেতনায় নতুন বছরকে সমৃদ্ধ করে তোলা। নতুন বছরে মুমিনের কয়েকটি করণীয়ের কথা এখানে তুলে ধরা হলো:
ঈমান নবায়ন:
ইমান কমবেশি হয়। কখনো শূন্য হয়ে যায়। এ জন্য ইমান নবায়ন করতে হয়। মহান আল্লাহর স্মরণে ইমান বৃদ্ধি পায়। নতুন বছরকে ইমান নবায়নের সূচনায় পরিণত করা যেতে পারে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, 'তোমাদের ইমান নবায়ন করো।' সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, 'কীভাবে ইমান নবায়ন করব, হে আল্লাহর রাসুল?' তখন তিনি বললেন, 'বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে থাকো।' (মুসনাদে আহমাদ: ৮৭১০)
খাঁটি তওবা:
অতীতের মন্দ কাজের জন্য বিশেষভাবে অনুতপ্ত হয়ে অনুশোচনা করে আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে এসব গুনাহ না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো-খাঁটি তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।' (সুরা তাহরিম: ৮)
আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা:
নতুন বছরের আগমনে মহান আল্লাহর কাছে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ কামনা করা যেতে পারে। আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা ও কল্যাণ প্রদান করেন।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'আমি কি তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে অন্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হব।' (সুরা ইয়াসিন: ২৩-২৪)
জীবনের হিসাব মিলিয়ে দেখা:
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুনির্দিষ্ট একটি সময়কাল দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এই সময়কালের কোনো
কমবেশি হয় না। যার জন্য যতটুকু সময় নির্ধারিত, ততটুকু ফুরিয়ে গেলেই জীবন শেষ হয়ে মৃত্যুর ডাক এসে যায়। নতুন বছর আগমনকালে বিগত বছরের পর্যালোচনা করা খুবই যৌক্তিক বিষয়।
অতীতের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নতুন বছরে নির্ভুল এবং পাপমুক্ত জীবন কাটানোর জন্য প্রত্যয়ী হওয়া উচিত। এভাবে পরকালে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশের মুখোমুখি হওয়ার আগে পৃথিবীতেই জীবনের হিসাব- নিকাশ করে নিতে হয়। নতুন বছরে ওমর (রা.) বলতেন, 'তোমরা তোমাদের নিজেদের হিসাব করে নাও-তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে।' (তিরমিজি: ২৪৫৯)
ছুটে যাওয়া নামাজ আদায়:
ইচ্ছে করে, অলসতা করে কিংবা কোনো কারণবশত ছুটে যাওয়া নামাজকে ইসলামের পরিভাষায় ‘উমরি কাজা’ বলে। আরবি ‘উমর’ অর্থ জীবন, আর ‘কাজা’ হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের পরে আদায়কৃত নামাজ। অর্থাৎ জীবনের ছুটে যাওয়া নামাজগুলো পরবর্তীতে আদায় করে নেওয়াই হচ্ছে উমরি কাজা। পেছনের বছর যে নামাজগুলো কাজা হয়েছে, লিস্ট করে সেগুলোর কাজা আদায় করা এবং আর যেন নামাজ কাজা না হয় সে সংকল্প করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নামাজ আদায় করতে ভুলে যায়, স্মরণ হওয়ামাত্রই যেন সে তা আদায় করে নেয়। এটাই এর একমাত্র ক্ষতিপূরণ।’ (বুখারি : ৫৯৭)
নতুন বছরের পরিকল্পনা:
নতুন বছর আগমনকালে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। সঠিক পরিকল্পনা সফলতার পথ দেখায় আর সঠিক নিয়ত কাজের গতি বাড়ায়। কাজের শুরুতে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নতুন বছর সামনে রেখে নিয়ত ঠিক করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ইমানদারদের প্রথম পরিকল্পনা হওয়া চাই আমল ও আখলাক নিয়ে। বছরের প্রথম দিন থেকে নামাজ-রোজাসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো যথার্থভাবে আদায়ের পরিকল্পনা, কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পরিকল্পনা, পরোপকার, দান-সদকা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা ইত্যাদি।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'এবং কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো, এরপর তুমি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে; যারা ভরসা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।' (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)
ইসলাম বিরোধী কাজকর্ম পরিহার:
নতুন বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো বা বিগত বছরকে বিদায় জানানোর সঙ্গে ইসলামের ইবাদত-বন্দেগি, রীতি-নীতি বা সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। 'থার্টি ফার্স্ট নাইট' পালন বা এ-জাতীয় আচার- অনুষ্ঠান মুসলমানদের জন্য অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা, নগ্নতা, মদ্যপান, যৌন-উন্মাদনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ইসলামে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজের সুযোগ নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমা লঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন-যাতে তোমরা শেখো।' (সুরা নাহল: ৯০)।
মুসলমান ভাইয়েরা! নিজের পরিবারের ব্যাপারে সতর্ক হউন, থার্টি ফার্স্ট নাইট মুসলমানদের উৎসব নয়, এটা মনে রাখতে হবে যে, এটা বিজাতীয় উৎসব। বিজাতীয় উৎসবে যারা অংশ গ্রহণ করবে, তারা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। মহানবী (সাঃ) বলেন, من تشبه بقوم فهو منهم “যে অন্য জাতির সাথে আচার-আচরণে, কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে সামঞ্জস্য গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভূক্ত বিবেচিত হবে। "আপনি কি চান? থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের সময় আপনার কাছে 'মালাকুল মাউত' আসুক? আপনার কাছে কি কোন গ্যারান্টি আছে যে, আপনি যখন কোন হোটেলে যাবেন, রাস্তায় নামবেন থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনোপলক্ষে তখন মালাকুল মাউত আসবেনা? আপনি যদি চান নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আপনি মারা যাবেন, তাহলে আপনার যা ইচ্ছা করেন। আমার কোন আপত্তি নেই। যদি আপনি চান যে, পাক-পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর কাছে যাবেন, তাহলে এই ধরণের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কোন সুযোগ আপনার নেই। কারণ, আল্লাহতো থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের সময়েও একটু কাঁপন দিতে পারেন। কাজেই আল্লাহকে পুরাপুরি ভয় করুন। হে মহামহিম, তুমি আমাদেরকে তোমাকে যথাযথ ভয় করার তাওফীক দান কর। আমীন।
মন্তব্য করুন: