প্রকাশিত:
১ জানুয়ারী ২০২৪, ১২:২০
প্রতিবছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো, ফানুস ওড়ানো একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের নানা বাধা নিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউই। এর অন্যতম কারণ, বেশির ভাগ মানুষই জানেন না আতশবাজি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর।
দশেজুড়ে ভয়াবহ আতশবাজি ও পটকা ফোটানো এবং ফানুশ উড়ানোর বিষয়ে বলতেই এ লেখার অবতারণা। বিষয়টি এখন আর ঢাকা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, দেশের সব বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২২ সালকে বরণ করে নিতে গিয়ে কী ঘটনা ঘটেছিল অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে। আতশবাজি ও ফানুশের কারণে কত জায়গায় আগুন ধরে গেল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গুদাম পুড়ে নিঃস্বও হলো কয়েকজন। আগুনে পুড়ে কত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হলো। কত গাছ পুড়ে গেল আর কত পাখি বেঘোরে প্রাণ হারাল, তা আমাদের কাছে বলতে গেলে গুরুত্বহীনই! সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বিপুল সমালোচনা তৈরি হয়।
গাছে গাছে পাখি সারাদিন কিচিরমিচির করে। কিন্তু থার্টিফার্স্ট নাইটে আশপাশের গাছপালার ডাল থেকে শালিক, ময়়না ও চড়ূইসহ নানারকম পাখি উড়াল দিয়েছে। পাখিগুলো আর্তনাদ করতে করতে এদিক সেদিক গিয়ে বসছে। আতশবাজির বিকট শব্দ। যখনই শব্দ হচ্ছে পাখিগুলোর অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আতশবাজির আগুন ছিটকে পড়ছে পাতায় পাতায়। ভয়ে-আতঙ্কে গাছে থাকা পাখিগুলো ছুটছে আর চিৎকার করছে।
পাখির যোগাযোগের মাধ্যম শব্দ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে পাখি চলাচলের রাস্তা ভুলে যায়। দেয়ালের সঙ্গে আঘাত খেয়ে অনেক পাখি মারা যায়। পাখি নগরে যুদ্ধাবস্থা মনে করে, নগর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে, তারা আর ফিরতে নাও পারে। তারা আর না ফিরলে প্রাণপ্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। পাখিরা না থাকলে ফুল এবং ফল পরাগায়ন হবে না। এতে উৎপাদন কমে যাবে। ফানুসের পোড়া বস্তু নিচে পড়লে উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আতশবাজি কতটা ক্ষতিকর, তা জানার আগে জানতে হবে, এটা কাদের জন্য ক্ষতিকর। মানুষ তো বটেই, পশুপাখির জন্যও আতশবাজি হতে পারে ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় পাখি।
"২০২১ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানোর কারণে ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিল। এই পাখিগুলো হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল আতশবাজির বিকট শব্দের কারণে।"
এই ঘটনাকে ‘গণহত্যার’ সঙ্গে তুলনা করেছিল প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা। থার্টি ফার্স্ট নাইটে পাখিদের মৃত্যু নিয়ে এ রকম আরও উদাহরণ আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, ভয়ে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে অনেক পাখি। এতে পাখিদের স্বাভাবিক জীবনক্রিয়া ব্যাহত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর অনেক দেশে আতশবাজি ফোটানো হলেও সেগুলো পরিবেশবান্ধব। ওইসব আতশবাজিতে ক্ষতিকর কেমিক্যালের পরিমাণ কম। কিন্তু বাংলাদেশে যেগুলো পোড়ানো হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। নিষিদ্ধ এসব আতশবাজি পাড়া-মহল্লার দোকানেও বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে।
এ রাতের ‘বেপরোয়া’ উদ্যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ শহর আরও বিপর্যস্ত হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক আহমেদুর রহমান ফেসবুকে লিখেছিলেন: ‘একটা বাচ্চা এসেছে ফানুস ওড়াতে গিয়ে মোম পড়েছে চোখে-মুখে, একজন তরুণের সরাসরি চোখেই আগুনের হালকা লেগেছে; কর্নিয়া ইনজুরি আছে, একজন পথচারী এসেছেন, তাঁরও মুখ ফানুসের আগুনে পুড়েছে, এক মাদ্রাসাছাত্র ফানুসের আগুনে বৈদ্যুতিক তার পুড়ছে দেখে সেটা নেভাতে গিয়ে নিজের হাত ইলেকট্রিক বার্ন নিয়ে এসেছে (সেই হাতে একটা বড় অপারেশন লাগবে), একজন “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু” আতশবাজি কাছ থেকে দেখতে গিয়ে চোখ-মুখ পুড়িয়েছে; বেচারা তার সমস্যার কথা বলতেও পারছে না, বেশ কয়েকজন এসেছে পটকায় এক বা একাধিক আঙুল উড়ে গেছে, এমন আরও অনেকে এসেছে।’
হাজার হাজার মানুষ যদি আতশবাজি ফোটায় আর ফানুশ ওড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। এরপরেও আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে সেটি পারে। তবে সেটি আরও বেশি কার্যকরী হবে, ডিসেম্বর মাস ধরে এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালালে। রাজধানীর বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের রেকর্ড নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এ রাতের বেপরোয়া উদ্যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ শহর আরও বিপর্যস্ত হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। নাগরিকেরা নিজেরা সচেতন না হলে কোনোভাবেই উৎসবের নামে এই ‘অরাজকতা’ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। দিন শেষে আমরা কেউ চাই না, আনন্দ উদ্যাপন করতে গিয়ে একটি শিশুর বা একটি পাখিরও ক্ষতি না হোক। আমরা চাই না, দুষ্ট ছেলের আনন্দের খেয়ালে করুণ পরিনতি হোক একটি ব্যাঙেরও।
দৈনিক নাগরকি সংবাদ এর শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন: