মঙ্গলবার, ২৬শে নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • সংঘর্ষে না জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের
  • যাত্রাবাড়ী-ডেমরায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
  • ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে অটোরিকশাচালকরা
  • ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন
  • ঢাকার ৫ এলাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
  • রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাত দখলে, যানজটের পাশাপাশি বাড়ছে দুর্ঘটনা
  • সম্পদের হিসাব দিতে আরও ১ মাস পাবেন সরকারি কর্মচারীরা
  • শপথ নিলেন নতুন সিইসি ও ৪ নির্বাচন কমিশনার
  • বঞ্চিত কর্মকর্তাদের গ্রেড-১ দেওয়া হবে
  • ৫ বিসিএসে ১৮ হাজার প্রার্থী নিয়োগ দেবে সরকার

ওরাও ইবির লোক

রবিউল আলম , ইবি

প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২৪, ১৫:৫৮

প্রতিটি ক্যাম্পাসের ভ্যান কিংবা রিক্সা চালকের প্রতি ছুড়ে দেওয়া শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের সম্বোধন_এই যে মামা যাবেন? সম্বোধনটা খুব একটা অচেনা নয় বরং দৈনন্দিন ক’বার যে উচ্চারণ করি তার অন্ত নেই। তাড়া থাকলে তো মামারা হয়ে যায় একেকটা বরের হাট মহার্ঘ। তবে...? এই যে মামা দ্রুত টান, এতক্ষণ লাগে?, ভাড়া বেশি কেন?, ভুল পথে আসলে কেন?, সামনে ভাঙা দেখে টান এবং ভাঙতি পাব কই? ইত্যাদি কত না অশুভ আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন মামারা! প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের চিত্র একই নয় কি?

সেই মামারা কারা? যারা- রাতে মাজারে খাবার খেয়ে ক্ষুধার আগুন চাপা দেয়। মৃদু প্রতিবাদ কিংবা এক-দুই টাকা বেশি চাইলেই ভাগ্যে জুটে নিতান্ত পক্ষে বকা বা মাঝেমধ্যে পাঁচ কপালে জুটে রিক্সাওয়ালা শব্দের ভ্রুক্ষেপ সহ চড়-থাপ্পড়। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নির্মম পেষণ নিরবে সইতে হয় তাদের। পরিবারের দায়ভার যেন পৃথিবী তাঁর কাঁধের উপর। স্ত্রী-সন্তানের মুখে সামান্য অন্ন তোলে দিতে ঘর্মাক্ত শরীরের প্রতিদান একটাই ভ্যানচালক বা রিক্সাচালক। সকালের সূর্য যাদের হাতে মুছে দেয় রিক্সার হ্যান্ডেল, আর সন্ধ্যার সিদ্ধ জ্যোৎসা প্রাণে বুলিয়ে দেয় একরাশ সান্ত্বনা। শহরের বড় বড় দালান-কোঠা দেখে কখনো কখনো যাদের মনেও স্বপ্ন জাগে বড় হওয়ার। মুহূর্তেই বস্তির জীবন আর রিক্সার মালিকের বীভৎস আচরণের কথা মনের সব স্বপ্নের আলো ঢেকে ফেলে মেঘে ঢাকা সূর্যের মত। পরক্ষণেই নতুন সকালের প্রত্যাশায় চোখে ঘুমের আবেশ জড়িয়ে হারিয়ে যাই অন্যলোকে। রিক্সা বা ভ্যানের চাকার সাথে যাদের জীবনের চাকা ঘুরে প্রতিদিন নতুন পথে, নতুন প্রত্যাশায়।


বলছি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একরের ক্যাম্পাসে দেখা মামাগুলির প্রতিদান ও প্রাপ্তির কথা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাতায়াতের বাহন হিসেবে ভ্যানের সহজলভ্যতা কিছুটা স্বতন্ত্র ইবি ক্যাম্পাস। প্রধান সড়ক কিংবা পকেট গেইট থেকে আবাসিক হল, প্রশাসন ভবন, ওয়াজিদ মিয়া ভবন, মেডিকেল, মীর মোশাররফ ভবন, কলা ভবন, টিএসসিসি, লেক ও পশ্চিম পাড়ায় দৈনন্দিন শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে না আসলেও ঠিকই মামাদের ভ্যানের চাকা অলিতে-গলিতে পৌঁছে যায়।

মামাদের একটাই প্রত্যাশা- ছেলের বয়সী মেধাবী শিক্ষার্থীটা যেন অশুভ আচরণ না করে এবং তুই-তোকারি কথা না বলে। পিতৃতুল্য বা সাধারণ মানুষের মতো আত্মসম্মান ফিরে পেতে সর্বদা উদগ্রীব। শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন প্রাপ্তির হাসি রেখা সবার মুখে। একেকটা মামা ১০-২০ বছর ইবি ক্যাম্পাসে ভ্যান চালকের সাক্ষী হয়ে আছেন যেন একেক জন এডভার্স পজিশন ভোগের উপযোগী। সম্মান দেওয়ার উপযুক্ত পজিশন ভুলে যাননি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) কর্তৃপক্ষ। প্রাপ্ত সম্মান ফিরিয়ে দিতে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্ব্যর্থ কণ্ঠে স্বীকার করে নিলো “ওরাও ইবির লোক”।

গত ২৪ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে চলাচলকারী অর্ধশতাধিক ভ্যানচালককে নিবন্ধিত করে আইডি কার্ড ও স্বতন্ত্র পোশাক প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। এতে উচ্ছ্বসিত ক্যাম্পাসের ভ্যানচালকরা।

একদিকে সময়ের তাড়া, অন্যদিকে সেমিস্টার ফাইনাল। রাস্তায় এসে চোখ ছানাবড়া দিকবিদিকশুন্য। ভ্যান ওঠার কোনো জো নেই। কারণ একটাই মানি ব্যাগ রুমে। এমনিতেই সকালবেলা ভ্যান সংখ্যা কম। হয়তো বেশি ভাড়া পাওয়ার আশায় জিয়া মোড় (ক্যাম্পাসের আড্ডাস্থল) থেকে দূরে বঙ্গবন্ধু পকেট গেইটের দিকে উঁকি দিচ্ছেন মামা। কোনো একটি ভ্যান আসামাত্রই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তার আগে আমার সমস্যাটা মামাকে শেয়ার করি। মামা, কত দূর যাবেন? জিজ্ঞেস করতেই ভ্যানচালক বললেন, ‘না যামু না, মালামাল আনা-নেওয়া করতেছি। সামনে গিয়া মালামাল নিমু।’ আমাকে একটু নিয়ে যান, বলতেই উত্তর দিলেন, ‘সামনে পর্যন্ত গেলে ওঠেন।’ অন্তত কিছুটা পথ হলেও আগানো যাবে—এই ভেবে ভ্যানে ওঠে পরলাম। দেখাদেখি আরও কয়েকজন ওঠে পরল। সহযাত্রীর গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ভ্যানের পাশে পা দুলিয়ে বসে রইলাম। রাস্তা অনেকটা ফাঁকা পেয়ে ভ্যানও দ্রুত চলতে লাগল। মামাকে আমার পরীক্ষার কথা বলা মাত্রই 'না' বলেননি। অবশেষে মীর মোশাররফ ভবনের ‘সামনে’ পর্যন্ত ভ্যান পৌঁছাল। ‘এইবার নামেন, গাড়ি ঘুরামু।’ অগত্যা নেমে পরলাম। ভাড়া তো নেই করমু কী? হ্যাঁ আমার মতো গোবরের মাথায় হঠাৎ সিন্ধান্ত হলো মামার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে রিচার্জ করে দিমু পরে। কিন্তু তাঁর নির্লিপ্ত জবাব, ‘ভাড়া লাগব না, আমি তো এমনিতেই আইতাম।’ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলাম। একরাশ হাসির ঝিলিক উপহার দিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পরলাম পরীক্ষা কেন্দ্রে। মামার একটু আত্মত্যাগ ও সহানুভূতিই আমার দিনটা স্বস্তিতে কাটলো।

মাসুদ রানা নামক এক ভ্যানচালক তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের একরকম আইডি কার্ড ও ইউনিফর্ম প্রদান করায় খুবই আনন্দিত। আমাদের এখন মনে হচ্ছে আমরা ক্যাম্পাসের সেবাদানকারী কর্মচারী। অনুষ্ঠানের বক্তব্যে এক স্যার অনুরোধ করল যে সবাইকে 'স্যার' সম্বোধন করতে - এটাও আমরা সাদরে গ্রহণ করলাম। আমরা সম্মান দিলে তো ওনারা ফিডব্যাক হিসেবে সম্মান-স্নেহ দিবেন। এটাও আশা করি যে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা আমাদের সাথে ভালো আচরণ করবে এবং আমরাও তাদেরকে সেবা দিয়ে যাব।

পারভেজ নামক এক ভ্যানচালক বলল, যেখানে আমাদের কথা শুনার মতো কেউ নেই, সেই মূহুর্তে এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে নিবন্ধিত করে নিলো, তা তো অনেক প্রাপ্তির বিষয়। আমার তখনই ভালো লাগে যখন একজন শিক্ষার্থী আপনি করে কথা বলে। ভ্যানে যাতায়াতের সময় পরিবারের অবস্থা জানতে চেষ্টা করে। ওইসব শিক্ষার্থীদের কারণে ক্যাম্পাসে থাকার অনুভূতিটাই আলাদা। সম্ভবত কোনো ক্যাম্পাসে এরকম নাই। আমরাই স্বতন্ত্র।

বসন্তপুরে বাড়ি ইসমাঈল নামক এক ভ্যানচালক বলেন, ক্যাম্পাসে প্রায় ১৩ বছর ভ্যান চালাচ্ছি। কত শিক্ষার্থী পরিচয়, তাদের নিজেদের কর্মস্থলে চলে গেল কিন্তু আমি ক্যাম্পাসে সেবা দিয়েই যাচ্ছি। ক্যাম্পাসের আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র ভিন্ন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়ছে। আমি তখনই তৃপ্তি পায় যখন কোনো রোগী বা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে মেডিকেল নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সেবা দিতে পারি। আমি আশা করব আমাদের সাথে শিক্ষার্থীরা ভালো আচরণ করবে।

যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামাদের ঘর্মাক্ত শরীরে একখানা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সম্বলিত স্বতন্ত্র পোশাক গায়ে মোড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে স্বকীয়তা ফিরিয়ে দিলো, ঠিক একইভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারি না? তখনই স্বার্থক হবে মামাদের সেবা। শিক্ষার্থীরা স্বীকারোক্তি দিবে কি “ওরাও ইবির লোক”?


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর