প্রকাশিত:
১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৬:১২
ভাষা মানেই ভাষা, নাহি বিকল্প আশা, ধ্যানে মগ্নে ভালোবাসা। বাংলাভাষা আর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি' শব্দ দুটোই সংগ্রামী চিন্তা-চেতনা, মুক্তি এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব প্রকাশ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি তরুণরা ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাতৃভাষার অধিকার। একারণেই তো বাঙালি জাতির কাছে একুশ মানেই সংগ্রামের অনুপ্রেরণা!
দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের ভাষা দিবসের ভাবনা ও একুশের চেতনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ও গ্রন্থনা করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাগরিক সংবাদ’র প্রতিনিধি রবিউল আলম।
“শুধু ফেব্রুয়ারিতেই ভাষার দরদ?”
আদনান জোবায়ের তাহজীব
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ৩টি শব্দই একটা মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফেব্রুয়ারি বাঙলির আবেগ, অনুভূতি মিশ্রিত একটি মাস। ১৯৫২ সালের এই মাসে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল কিছু অকুতোভয় তরুণ। তাদের প্রাণের বিনিময়েই আজ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠান পেয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ভাষা হিসেবে। কিন্তু যে ভাষার জন্য এতো আন্দোলন এতো সংগ্রাম সেই ভাষা কেই আমরা আজ করছি পদদলিত। দিন দিন আমরা ঝুঁকে পড়ছি বিদেশি ভাষার দিকে যা আমার ভাষা আপনার ভাষা বাংলাকে করছে বিকৃত। পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা হিসেবে খ্যাত বাংলার প্রতি আমাদের টান সৃষ্টি হয় শুধু ফেব্রুয়ারিতেই, যা বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার! রক্তের বিনিময়ে যে ভাষা কে আমরা পেয়েছি আমাদের উচিত সর্বক্ষেত্রেই সেই ভাষাকে ব্যবহার করা। পাশাপাশি বিশ্ব মঞ্চে বাংলার অবস্থান উন্নতি করা।
“ভিন্ন সংস্কৃতি পরিহার হোক এবারের প্রত্যয়”
সাইদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষা ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম, একটি জাতির সংস্কৃতি ভাব কল্পনা এবং অস্তিত্বের পরিচায়ক হল 'ভাষা'। তেমনই বাঙ্গালী জাতির একটা নিজস্ব পরিচায়ক হল "বাংলা ভাষা"। এ ভাষা নিছক কোন কচুপাতার পানির মতো ভেসে আসা কোন ভাষা নয়। আজকের এই ভাষাকে পরিণত করতে হাজারেরও বেশি সময়ে ধরে কাঠখড় পোহাতে হয়েছে এ জাতির। প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব, মঙ্গল, পদ্মাবতী কিংবা আধুনিক যুগে মধুকবির মেঘনাদবধ, রবীন্দ্র-নজরুল এবং বায়ান্নের রাজপথে তাজা রক্ত দানের মধ্যে দিয়ে ক্রমবিকাশ হয়েছে এই ভাষা। অথচ এই বাঙ্গালির বেশিরভাগ জনবলই সঠিকভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি না। তার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক হলো, 'ভাষা দিবস' উদযাপন করি হিন্দি ইংরেজি এবং ভিন্ন দেশীয় ভাষার গান দিয়ে। বাঙালি জাতি হিসেবে জাতির পরিচায়ক বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগবিধি জেনে থাকা অতন্ত্য জরুরি বলে মনে করি। এবং ভাষার মাসে অন্তত ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর গান দিয়ে বাঙালি জাতির "মাতৃভাষা দিবস" উদযাপন করা উচিৎ নয় বলে মনে করি।
“রক্তমাখা বর্ণমালার ইতিহাস জানা দরকার”
রিফাত মাশরাফি প্রত্যয়
শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
১৯৫২ থেকে ২০২৪, ৭২ টি বসন্ত পার হয়ে গিয়েছে। ভাষার জন্য ইতিহাসের একমাত্র এবং প্রথমবারের মত রাজপথে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর-রা। অনেক আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই মাতৃভাষা। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই মাতৃভাষার ভুল ব্যবহার আজ সর্বত্রে। দেশের একজন সচেতন তরুণ নাগরিক হিসেবে যেটা অন্তরে প্রচন্ড আঘাত হানে। দেশের একজন তরুণ নাগরিক হিসেবে সবসময় প্রত্যাশা করি বাংলা ভাষার সকল ভুল এবং অপব্যবহার দূর হোক। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিশ্চিত করা হোক বাংলা ভাষার যথাযথ এবং সঠিক ব্যবহার। সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর দের ঋণ কোন দিনই শোধ হবার নয়। কিন্তু আমাদের এই যথাযথ বাংলা ভাষার ব্যবহার একটু হলেও হয়তো তাদের ঋণ শোধ করতে সাহায্য করবে।
“শুদ্ধ ভাষার চর্চা হোক”
আজিজুর রহমান
শিক্ষার্থী, জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বাসার মাস ফেব্রুয়ারি এলে আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই ভাষা সংগ্রামীদের যাদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ৫২ রাজপথ। বাসার মাস বাঙালি জাতির কাছে আত্মত্যাগ শ্রদ্ধা ও অহংকারের মাস। ১৯৫২ সালে এই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য রফিক বরকতের আপ্রাণ দিলেও বর্তমানে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার আমরা দেখতে পাই না৷ ইংরেজি ভাষায় কথা বলাকে আধুনিক স্মার্টনেস বলে থাকি। অথচ চলিত বাংলায় কথা বলতে পারি না। ভাষার চর্চা শুধু আবদ্ধ না থেকে সারা বছর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষা চর্চা করা হোক। তাহলে ভাষার জন্য যে ত্যাগ তা স্বার্থক হবে।
“কালের গর্ভে যেন ভাষার গুরুত্ব হারিয়ে না যায়”
শাকিবুল হাসান
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও ইতিহাস সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে বাংলা ভাষা ও শহীদদের প্রতি মমত্ববোধ তাও কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর চলছে। এর মধ্যেই রক্তের দিয়ে অর্জিত এই ভাষার প্রতি পরিলক্ষিত হচ্ছে চরম অবহেলা। প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে ধারণ করে আমরা এখন ইংরেজিতে কথা বলাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। মনে করি এটাও বুঝি আধুনিকতা। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের আমাদের দায়িত্বও শুধু ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ সকালে শহিদ মিনারে ফুল দেওয়া এবং 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ' গান গাওয়া ব্যাস্। আবার ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজি অক্ষর এবং বাংলা অর্থ যাকে বলা হয় বাংলিশ– এ আমরা অভ্যস্ত। এ যে আমাদের ভাষার জন্য চরম অপমানের তা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। এটি শুধু ভাষার প্রতি অবহেলাই নয় বরং শহীদদের ত্যাগের প্রতিও অসম্মানজনক। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে বাংলা ভাষাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। তা-না হলে কালের গর্ভে বাংলা ভাষার গুরুত্ব, ইতিহাস হারিয়ে যাবে।
“আইন-বিচারে বাংলা ভাষার ঠাঁই হোক”
মো: বাবুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও আমরা বাংলাভাষা সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি না। উচ্চশিক্ষার অধিকাংশ পড়ালেখা হয় ইংরেজিতে। বিশেষ করে আইনের শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্যবহার ক্ষেত্রসমূহ খুবই নগন্য। আইনের পাঠ্যবইসমূহে বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। এমনকি বিচার কর্যক্রমে হাইকোর্টের রায় প্রদানেও বাংলা ব্যবহার করা হয় না। তাছাড়াও বিভিন্ন চাকরির ভাইবা পরীক্ষাগুলোতে মুক্তভাবে বাংলা ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। এখানেই শেষ নয়, বর্তমানে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কথোপকথন বাংলায় হলে সমাজের চোখে আন-স্মার্ট হিসেবে পরিচিত হতে হয়। অথচ এই বাংলা ভাষার জন্য আমার ভাইদের প্রাণ দিতে হয়েছে। কত রক্ত ঝরেছে! তবুও বাংলা ব্যবহারে স্বাধীনতা নেই।
“সর্বত্র বাংলা প্রচলন সময়ের দাবী”
জে এম রফিকুল সরকার
তরুণ লেখক ফোরামের সদস্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস।রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা যা বিশ্বে বিরল ও ব্যতিক্রম। ভাষা আমাদের আবেগ অনুভূতির কেন্দ্রস্থল। সর্বক্ষেত্রে বাংলা আজও প্রচলন মাধ্যম হয়ে ওঠেনি যা দুঃখ তথা পরিতাপের বিষয়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমার দাবী, বাংলাকে সর্বত্র প্রকাশ মাধ্যম করা, যাতে সকলের আবেগ অনুভূতির একমাত্র মাধ্যম হিসেবে নিজেকে জানান দিতে পারে।ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হবে যার মধ্য দিয়ে। ভাষাকে সতেজ ও সজিব রাখার জন্য শুদ্ধ ও সহজ সরল ভাবে ভাষাকে ব্যবহার করা উচিত। বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যেন সব সময়ই অটুট থাকে, এমন দৃঢ প্রতিজ্ঞ হওয়া উচিত।
২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস,৮ই ফাল্গুন কেন নয়?
শাহ বিলিয়া জুলফিকার
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। রয়েছে একটি মাতৃভাষা দিবস। যা এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো পৃথিবী জুড়ে 'মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। গর্বের কথা সন্দেহ নেই। তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়! আমরা মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারি বলি কেন ? ৮ই ফাল্গুন বলি না কেন ? তা জানা ও আলোচনা করা দরকার। প্রশ্নের জবাবে অনেকে হয়তো বলবে, আগে জাতীয় পর্যায়ে ছিল, এখন আন্তর্জাতিক তাই! জবাবে বলবো, এখন নেই, এক সময় তো ছিল জাতীয় পর্যায়ে? আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুব বেশি বছর হয়নি। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।আর জাতিসংঘও কিন্তু অযথা এ দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এর পিছনে রয়েছে, পৃথিবীতে প্রথম মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার মতো করুণ এক ইতিহাস।সময়টা ছিলো ১৯৫২ সাল।এই দেশ তখন স্বাধীন সার্বভৌম 'বাংলাদেশ ' ছিলো না, তখন এটি ছিলো 'পূর্ব পাকিস্তান'।তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী চেয়েছিলো, বাংলার পরিবর্তে উর্দু কে এদেশের মাতৃভাষা হিসেবে চালু করতে।কিন্তু মাতৃভাষা প্রেমীরা তা চায়নি, হতে দেয়নি। তারপর, তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল! সে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে।দিনটি ছিলো,১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ। এখন তবে প্রশ্ন থেকে যায়। শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দিবস টিকে আদৌ যথাযথ উদযাপন করা হচ্ছে ? খানিকটা হলেও না! কারণ এখন দেখা গেছে, আমরা শুধু মাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারি বলি,কেউ, কখনই ৮ই ফাল্গুন নামোল্লেখ করি না। ভুলে যায় বাংলা কতো সালের,কোন মাসের কতো তারিখে শহিদেরা জীবন দিয়েছিল,ভুলে যায় বাংলা মাসের নাম,অথচ মাতৃভাষা দিবস পালন করি। এমনকি কোনো আলোচনা সভায়, কোথাও ৮ই ফাল্গুন ব্যবহার করি না।
পরিশেষে বলতে চাই,আমরা যদি অন্তত এভাবে বলি,"আজ মাতৃভাষা দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন) "কিংবা বাংলা মাসের কত তারিখে শহিদেরা তাদের জীবন দিয়েছিল, নিজ মাতৃভাষার জন্য তা যদি উল্লেখ করি। তাহলে শহিদদের আত্মাগুলো শান্তি পেত, খুশি হতো।
মন্তব্য করুন: