প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২৪, ১৯:৩০
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে মাদকদ্রব্যের সাথে পরিচিত হয়ে তা বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে আসছে। কখনও সামাজিক রীতি অনুযায়ী, কখনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, অনেক সময় আনন্দ-ফূর্তিতে, কখনও বা ক্লাবে-হোটেলে। আর বর্তমানে এর বিস্তার ঘটেছে প্রকাশ্যে। যা পানির স্রোতের বেগে সমাজের সর্বশ্রেণীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে সকল মাদকদ্রব্য বেশী চলছে তা হ’ল-বিড়ি-সিগারেট, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাজা, আফিম, ইয়াবা, প্যাথেড্রিন, মদ, হুইস্কি, তাড়ি, তামাকজাত দ্রব্য সহ আরো নিত্য নতুন কিছু মাদকদ্রব্য যা কিনা বিদেশ থেকে চোরাইপথে বাংলাদেশে আসে। এছাড়া অন্যান্য মাদকদ্রব্যগুলোর মধ্যে আছে- কোকেন, ক্যাফেইন, হাশিশ, মরফিন প্রভৃতি।
মাদকাসক্তি হচ্ছে অভ্যাসগত চেতনা উদ্রেককারী দ্রব্যের ব্যবহার। যা মানসিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে এবং সামাজিক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৮৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকাসক্ত বলতে, শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাস বশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীকে বুঝানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মাদকের ভয়াবহতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কল্পনাতীত। আর এ কারণে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস লিলার গভীর জ্বলে নিপাতিত হচ্ছে, আমরা হারিয়ে ফেলছি সুস্থ্য ও মানবিক আগামী প্রজন্ম। আমরা জাতিগত ভাবে হারিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে ফেলছি আমরা আমাদের ঐতিহ্য। আমার বড্ড ভয় হয় আমরা আমাদের এই স্বাধীন রাষ্টকে ভবিষ্যতে কোন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি। যার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি তারা মাদকসেবী নয়তো? মাদকের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোন মন্তব্য করেছেন, ‘যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ এ তিনটির প্রভাবে যত ক্ষতি হয় তা একত্রে যোগ করলেও মাদকে যে ক্ষতি হয় তা অনেক ভয়ংকর’।সরকারী মাদক অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট মাদকাসক্তের ৯০ শতাংশই কিশোর, যুবক ও ছাত্র-ছাত্রী। যাদের ৫৮ ভাগ ধূমপায়ী এবং ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। মাদকাসক্তদের গড় বয়স এখন ১৩ বছরে এসে ঠেকেছে। আসক্তদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৭ বছরের মধ্যে। সেই সাথে বিস্ময়কর তথ্য হ’ল যে, দেশের মোট মাদকসেবীর মধ্যে অর্ধেকই উচ্চশিক্ষিত। দিন-মজুর, রাজমিস্ত্রী, রড মিস্ত্রী, বাস-ট্রাক, বেবী ট্যাক্সী ও রিক্সা চালকদের মধ্যেও বহু মাদকাসক্ত রয়েছে। আর এটা জানা কথা যে, মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আমাদের দেশে ৩৫০টি (কম বেশি হতে পারে) বৈধ গাঁজার দোকান আছে। সরকার অনুমোদিত একমাত্র মদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু এন্ড কোম্পানি।বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেশীয় মদ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ও বিক্রি হয়। আজকাল মাদকদ্রব্য বিভিন্নভাবে সেবন বা গ্রহণ করা হয়।এক ধরণের মাদক আছে যা নাকে টানা হয়। আবার কোনো দ্রব্য ধোয়ার সাথে পান করা হয়। আবার কোনটি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের নেশাগ্রস্ত দিকভ্রান্ত তরুণ সমাজ। একজন তরুণের স্বপ্নভরা কৈশোরের ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো ভাঙছে দিন-রাত তার পাশে অরাজকতা বৈষম্য-শোষন। বর্তমানে তরুণরা আস্থা হারাচ্ছে জীবনে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস থাকছে না, আর্থিক কাঠামো এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসেরও শ্রদ্ধা নেই। ব্যবসায়িক স্বার্থে হেরোইন আসছে নানা পথে নানা মাধ্যমে ব্যবহার করছে স্বপ্নভাঙা মেরুদন্ডহীন যুবক সমাজ। মধ্যবিত্ত ও সচেতন সমাজই নেশার শিকার, এদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে আসমান জমিন তফাত, যার পরিণতি সুনির্মল, উর্বর মেধার অপমৃত্যু, উজ্জ্বল পরমায়ুর অবক্ষয়। বিশ্বজুড়ে যে মাদকবিষ ছড়িয়ে পড়েছে তার থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশে দেশে নানা সংস্থা ও সংগঠণ মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যম মাদকবিরোধী জনমত গঠণে সক্রিয় হয়েছে, কিন্তু এর প্রভাবে আমরা মাদক কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? এই চরম সংকট থেকে আমাদের বাচতে হলে, মাদকদ্রব্যের প্রচার ও প্রসার রোধে সমাজের নেতারা নিজ নিজ স্থান থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নেতা বা সর্দার যদি মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন, তবে সে এলাকায় মাদকের অবাধ ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারের। কেননা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই সরকারের প্রধান দ্বায়িত্ব। শক্ত হাতে মাদকাসক্তির মতো অন্যতম অপরাধ দমন করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম থেকে বর্তমান সময় ও মানুষকে বাঁচাতে হলে এই ভয়াল ব্যাধির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ মানুষকে মাদকাসক্ত করে, তরুণদের কর্মসংস্থান করলে তারা কর্মময় জীবনযাপন করবে। সবচেয়ে বড় কথা, মাদকাসক্তদের যেমন নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা জরুরি তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মাদকব্যবসায়ীদের আইনানুকভাবে শাস্তি দেওয়া। এছাড়াও ধর্মীয় মূল্যবোধ সর্ম্পকে আমাদের ছোট ছোট শিশু কিশোরদের সহ স্কুল-কলেজে শিক্ষা প্রদান করা উচিত।পরিশেষে মাদকের ব্যবহার এখন জাতীয় সমস্যারূপেই বিবেচিত হচ্ছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, ক্ষমতালোভী, রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এরা প্রত্যেকেই এই ভয়াবহ অবস্থার জন দায়ী। সবাই মিলে সংগঠিতভাবে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের রক্তে কেনা এই স্বাধীন বাংলাদেশকে একদল মাদকসেবী উম্মাদ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যেতে হবে, যার ফল স্বরুপ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আরো কয়েকশত বছর করতে গোলামী।
মন্তব্য করুন: