প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩৫
ডোমঘরে ভাবলেশহীন মলিন মুখ আর কোঁকড়া চুলের বৈশাখের কাছে একটি লাশ আসে। সেই লাশের শরীরে একটি চিহ্ন দেখে আঁতকে ওঠে বৈশাখ। তার মনে ভয় ধরে যায়। এই ভয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুখদুঃখের স্মৃতি, না পাওয়ার ব্যাকুলতা, দুবেলা খেয়ে–পরে থাকার সুখী সংসারের স্বপ্ন। এই সব আক্ষেপ পূরণের আশায় আট বছর আগের প্রেমকে আঁকড়ে ধরতে একমুহূর্তও দেরি করেনি বৈশাখ।
এই বৈশাখের প্রেম, ভয়, ব্যাকুলতা আর আক্ষেপের সংসারের সিনেমা ‘দেয়ালের দেশ’। ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ১১টি সিনেমার একটি। মুক্তির আগেই যে কটি সিনেমা ট্রেলার ও গান দিয়ে আলোচনায় ছিল, তার মধ্যে ‘দেয়ালের দেশ’ অন্যতম।
ধীর–স্থির লয়ের সিনেমায় বৈশাখ (শরিফুল রাজ) আর নহরের (শবনম বুবলী) প্রেমে উথালপাথাল কিছু ছিল না। ছন্নছাড়া বৈশাখের ক্রিকেট খেলা নিয়ে জুয়া আর নিয়ম করে নহরের সঙ্গে সময় কাটানোতেই জীবনের সব সুখ। নহর যদি এক দিনও রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখে, সেটা মেনে নিতে পারে না বৈশাখ। তার কথা, মারামারি, ঝগড়া যা খুশি হবে, কিন্তু কথা বলা বন্ধ করা যাবে না।
উচ্চবিত্তের ঘরে অসুস্থ এক বয়স্ক মানুষের সেবাযত্নের চাকরি নহরের। ওই বাসার সামনের রাস্তার ওপারে এক কানে হেডফোন গুঁজে গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নহরের বৈশাখ। যদিও এ বাসার সামনে আসতে বারণ করে নহর, তবু বৈশাখ আসে। চাকরিদাতা কণাও বারান্দা থেকে তাদের এই প্রেম দেখে।
সিনেমায় নহরের মায়ের একটি কথা আছে, যার মর্মার্থ হলো, নারীর নিজের কোনো কিছু বলার নেই, তার সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক বাবা, স্বামী ও ছেলে। নিম্নবিত্ত ঘরের এই নারীর জীবনের গল্পে এর চেয়ে অন্য কোনো বোধ হওয়ার কথা নয়। সেই বোধের চাপে ও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নহরও ঝাঁপ দেয় ওই ‘নারীদের’ জীবনে।
পরিচালক মিশুক মনির প্রথম ছবি হিসেবে এই যুগলের ভালোবাসাকে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। কিছু অসংগতি আছে। পুলিশ কর্মকর্তা যখন বৈশাখকে নহরের পরিণতির কারণ জানায়, সেটা একটু কেমনই যেন লাগে।
উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ভালোবাসার চাহিদাকে সমান্তরালে দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক। কিন্তু উচ্চবিত্ত দম্পতি দিনার (শাহাদাৎ হোসেন) ও কণা (স্বাগতা) চরিত্র দুটোকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। একপর্যায়ে মনে হয়েছে যে এই দুই চরিত্র ছাড়াও সিনেমাটি এগিয়ে যেতে পারত।
অভিনয়ের দিক থেকে শরিফুল রাজকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ দিয়ে তিনি এর আগেই জানান দিয়েছেন যে বাংলা চলচ্চিত্রের ঘরে এক জাত অভিনেতার জন্ম হয়েছে। এর আগে ‘টান’ সিনেমায় বুবলীর কাজ দেখা হয়েছিল। ভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্রে তিনি বেশ মানিয়ে গেছেন। ব্যক্তিজীবনের জন্য দুজনই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই আলোচনায় থাকেন। আপনাদের ব্যক্তিজীবন কি একটু চাপিয়ে রাখা যায়?
‘দেয়ালের দেশ’ ছবিতে নহরের বাসা সদরঘাটের পাশে, যে বাসার ছাদ থেকে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। সেখানে নৌকায়, লঞ্চের ছাদে নহর ও বৈশাখ গল্প করে। সিনেমাটিতে একই সড়কের ফুটপাত দিয়ে তাদের হেঁটে চলার দৃশ্য কয়েকবার আছে। সেটা না হলেও চলত।
সম্প্রতি বেশ কিছু সিরিজ ও সিনেমায় সদরঘাটের কয়েকটি বাড়ি এখন দর্শকের চেনা হয়ে গেছে, যেগুলোর ছাদ থেকে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। যাঁরা নিয়মিত দেশীয় সিরিজ ও সিনেমা দেখেন, তাঁদের কাছে এই একই জায়গার দৃশ্যায়ন একঘেয়ে হয়ে গেছে। যদি ঢাকাকেন্দ্রিক গল্প হয়, সেখানে শহরের অন্য প্রান্তেও পরিচালকেরা যেতে পারেন। সদরঘাট, লঞ্চ আর ওই নদী দেখা ছাদের বাড়িকে রেহাই দিন প্লিজ।
শেষে কী হলো নহর আর বৈশাখের? আট বছর আগেই শীতে নহরকে ঘরে তুলতে বলেছিল সে। দুইবেলা খেয়ে–পরে থাকা এক সংসারের আশা ছিল তার। নহর ঠিকই সংসার করে বৈশাখের সঙ্গে। শহরের দেয়ালে দেয়ালে একদিনের সেই সংসার এঁকে চলে বৈশাখ।
শুধুই প্রেমের গল্পে ডুব দিতে চাইলে ‘দেয়ালের দেশ’ হতাশ করবে না। আর দেখা শেষে কানে হয়তো বাজতে থাকবে—‘বেঁচে যাওয়া ভালোবাসা আমার জন্য রেখে দিয়ো’।
মন্তব্য করুন: