প্রকাশিত:
১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩২
‘এই ছেলে, তুমি কি হর (সাঁওতাল) নাকি?’
‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’
‘শুনলাম সাঁওতাল ছেলেরা নাকি এই মেলায় এসে বিয়ের জন্য কনে খোঁজেন?’
‘হুমম, ঠিকই শুনেছেন। আমিও খুঁজতে এসেছি।’
পয়লা বৈশাখের দিন দুপুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়নে ঝালপুকুর গ্রামে অনুষ্ঠিত চড়ক মেলায় কথা হচ্ছিল সাঁওতাল তরুণ রাজেন মার্ডির সঙ্গে। কথিত আছে যে এই মেলায় এসে সাঁওতাল যুবকেরা তাঁদের জীবনসঙ্গীকে খুঁজে নেন।
রাজেন মার্ডি বলছিলেন, তাঁর বয়স ২২ বছর। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বাড়িতে মা ও এক ছোট ভাই নিয়ে সংসার। তাঁর মতে, সহজে বিয়ের জন্য কনে খুঁজে পাওয়ার জন্য এই মেলা একটি ভালো মাধ্যম। মনের মতো কনে খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া অনেক খাটুনির ব্যাপার। তাই সাঁওতাল তরুণ-যুবকেরা এই মেলায় এসে কনে খুঁজে নেন। মনের মতো কনের দেখা পেলে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমান। দুজন দুজনকে নিজেদের পরিবার ও নিজেদের তথ্য আদান-প্রদান করেন। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা হলে উভয়ের পরিবারের মাধ্যমে বিয়ের আয়োজন করা হয়।
রাজেনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সেই সময়ই নিজেদের মধ্যে হাসি-গল্পে মশগুল কয়েকজন মেয়ে হেঁটে যান। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের গাঁয়ের মেয়ে। মেলায় এসে গাঁয়ের মেয়েদের পছন্দ করার নিয়ম নেই।’
কথা না বাড়িয়ে যে কাজে মেলায় এসেছেন, সেই কাজে সময় দিতে হবে জানান রাজেন। কথা দিয়ে যান, কনে পছন্দ হলে তিনি মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানাবেন সে কথা।
বিকেলের দিকে এই মেলায় দেখা যায়, পিঠে বড়শি বিঁধিয়ে নয়, কোমরে গামছা বেঁধে শিশু-কিশোরদের চড়কে ঘোরানো হচ্ছে। চড়কদণ্ডের পাশে অল্প দূরে বাঁশের তৈরি উঁচু একটি মঞ্চ। মই দিয়ে উঠে সেখানে বসলেন ঝালপুকুর গ্রামের মোড়ল গণেশ মাহাতো (৭৬)। এরপর একের পর এক শিশু উঠল। চড়কদণ্ডের যে বাঁশটি ঘুরবে, সেই বাঁশের সঙ্গে শিশুর কোমর গামছা দিয়ে বেঁধে দিলেন মোড়ল। বাঁশের সঙ্গে বাঁধা ঝোলানো রশি ধরে চার থেকে পাঁচজন যুবক গোল হয়ে ঘুরলেন। সঙ্গে ঘুরতে থাকল চড়ক। প্রথমে ঘুরল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ঝালপুকুর গ্রামের সন্দীপ মাহাতো। এক থেকে দেড় পাক করে একে একে ১০ জনকে ঘোরানো হলো। ঘোরার সময় সবার হাতে ছিল বাঁশের তৈরি একটি ঝুড়ি। ঝুড়িতে রাখা বাতাসা, ফুলের পাপড়ি ও পাতা তারা ছিটিয়ে দেয় নিচে দিকে। আঁচল-গামছা পেতে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষেরা তা লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ ফোটানো ছাতা উল্টো করে ধরে ছিটানো বাতাসা, ফুল, পাতা পাওয়ার চেষ্টা করেন। মাটিতে পড়ে যাওয়া বাতাসাও কুড়িয়ে নেওয়া হয়।
গ্রামের এই মেলা সম্পর্কে গণেশ মাঝি বলেন, ‘আমার বাবা-দাদারাও বলতে পারেননি ঠিক কবে থেকে মাহাতোদের আয়োজনে এই মেলা হয়ে আসছে। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে চড়কপূজা হতো। চাঁদের আলোয় রাতজুড়ে মাদল-বাঁশির তালে তালে আদিবাসী মেয়েরা নাচগান করতেন। সকালের লাল সূর্যের মিষ্টি আভায় চড়ক ঘুরিয়ে মেলা শেষ করা হতো। মেলা থেকে মানুষ কিনে নিয়ে যেত মিঠাই, মণ্ডা,শিশুদের খেলনা। মেয়েরা চুড়ি-ফিতা, আলতা-সিঁদুর, শাখা-পলা, দা-বঁটিসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিস। তবে ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে রাতে আর মেলা বসে না।’
তিনি আরও জানান, যখন থেকে রাতের মেলা বন্ধ হলো, তখন থেকে রাতভর নাচ-গানের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো মেলায় আসা মানুষেরা। এরপর চরকা ঘোরানোর আগে সাঁওতালদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল এসে নাচ-গান করত। কয়েক বছর থেকে তা-ও বন্ধ গেছে। আগের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে এ মেলার। তবে এখনো সাঁওতাল মেয়েরা সেজেগুজে মেলায় আসে। সাঁওতাল যুবকেরা আসেন কনে খুঁজতে। কেউ পান, কেউ পান না। তবে এগুলো জানা যায় না, গোপনেই থাকে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সাঁওতাল যুবকদের মেলায় এসে বিয়ের জন্য কনে খোঁজার এই বিশেষত্বটুকু টিকে আছে আজও।
মন্তব্য করুন: