প্রকাশিত:
২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৮
বর্তমানে দৈনিক দেশীয় কূপগুলো থেকে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। গ্যাসের উৎপাদন আরো ৭৫ শতাংশ (এক হাজার ৪৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট) বাড়াতে সরকার ১০০টি কূপ খনন এবং ওয়ার্কওভারের (সংস্কারকাজ) উদ্যোগ নিয়েছে।
আগামী ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি কূপ খনন এবং ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা।
মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ দেবে সরকার, বাকি ৩০ শতাংশ কম্পানিগুলো নিজস্ব ফান্ড থেকে দেবে। জ্বালানি বিভাগ এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘একসময় দেশীয় গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় দুই হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেটি কমতে কমতে এখন দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।
আমরা ২০২৮ সালের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে নিয়ে যেতে চাই। এর জন্য চলমান ৪৮টি কূপ খননের পাশাপাশি নতুন আরো ১০০টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভাবের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘সমুদ্রেও গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা বিবেচনায় এলএনজি আমদানির চুক্তিও বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে আরো এলএনজি টার্মিনাল করারও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ। তাই এখন দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।’
পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ৫২টি কূপ খনন ও ১৬টি কূপ ওয়ার্কওভারের কাজ করবে।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) করবে ৯টি কূপ খনন ও ১২টির ওয়ার্কওভারের কাজ। সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) আটটি কূপ খনন ও তিনটি কূপ ওয়ার্কওভারের কাজ করবে। কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার সম্পন্ন হলে বাপেক্স জাতীয় গ্রিডে দৈনিক এক হাজার ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পারবে। একই সঙ্গে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করে বিজিএফসিএল ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং এসজিএফএল ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ বাড়াতে পারবে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, ১০০টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রমে বাপেক্সের সক্ষমতাকে শতভাগ কাজে লাগানো হবে। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শেষ করতে আউটসোর্সিং কম্পানির সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শোয়েব বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা পেট্রোবাংলা থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। কাজটি ২০২৫ সালের দিকে শুরু হলেও এরই মধ্যে আমাদের কর্মপরিকল্পনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা গেলে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। বর্তমানে আমাদের পাঁচটি রিগ (খননযন্ত্র) রয়েছে। এর মধ্যে চারটি রিগ দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে খনন কার্যক্রম চালু রাখা যাবে।’
পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গত শনিবার (২০ এপ্রিল) গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে দুই হাজার ৯৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার ৯৯৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, বাকিটা আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি ছিল প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার কারণে ২০৩০ সালে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশাল এই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই সরকার দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এলএনজি আমদানি আরো বাড়াতে চায়। এর জন্য কাতার ও ওমানের পর মার্কিন কম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তির আওতায় ২০২৬ সাল থেকে পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছর এলএনজি সরবরাহ করবে তারা। এই লক্ষ্যে দেশে আরো তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
পেট্রোবাংলা কর্তৃক প্রস্তুত করা গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ প্রক্ষেপণে দেখা গেছে, ২০২৯-৩০ অর্থবছরে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা হবে পাঁচ হাজার ৯২ মিলিয়ন ঘনফুট। ওই অর্থবছরে এলএনজিসহ মোট গ্যাস সরবরাহ দাঁড়াবে দৈনিক চার হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তখনো চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো ঘাটতি থাকবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই দশকে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ায় ব্যাপকভাবে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। ফলে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে। চাহিদা সামাল দিতে সরকারকে ২০১৮ সাল থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এলএনজি আমদানিতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ছে। দেশে চলমান ডলার সংকটের কারণে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে সরকারকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে গ্যাস উৎপাদনে বেশি নজর দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও নরওয়ের বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কম্পানি স্টেট অয়েলের (বর্তমানে ইকুইনর) গবেষক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই উদ্যোগ জ্বালানি খাতের উন্নয়নে খুবই জরুরি। তবে বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং হবে। এর জন্য সিসমিক সার্ভে, কূপ খনন, গ্যাস প্রসেস প্লান্ট স্থাপন, গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় ও বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। প্রজেক্টের অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে পারলেই এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’
এদিকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এসব কূপ থেকে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানান পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মন্তব্য করুন: