প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২৩, ২০:০০
বাংলাদেশে রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, দল-মত-নির্বিশেষে তাঁদের অনেকের মধ্যেই একটি সাধারণ অভ্যাস আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। সেই অভ্যাসটি আর কিছুই নয়, তাঁরা খুব বেশি কথা বলে ফেলেন। আর বেশি কথা বলতে গিয়ে যেমন অপ্রয়োজনীয়, অশোভন ও মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে হয়। প্রায়ই কথার মধ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য এসে যায়।
রাজনীতিবিদদের তো কথা বলতেই হবে, হোক না মাঠে-ময়দানে বা কোনো অডিটরিয়ামে; কিন্তু এভাবে? অবশ্য রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তি—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা আমাদের বুঝতে হবে।
রাজনীতি যাঁরাই করুন না কেন, রাজনীতির মঞ্চে বা মাঠে-ময়দানে-মিছিলে বক্তব্য রাখার সময় তাঁদের অবশ্যই বিষয়বস্তুর প্রয়োজনীয়তা, ধরন, শব্দ চয়ন ও মানহানি বা শালীনতার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তাঁদের প্রতিটি কথাই কিন্তু সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। ছোটবেলায় জানতাম যে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সমাজের তথা দেশের আদর্শ, অন্যরা তাঁদের অনুসরণ করে।
কিন্তু এ দেশে এখন কী দেখছি? অসৎ হওয়ার অতি সহজ পথটি যেন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া, যে পথের নেতৃত্বে রয়েছেন অনেক আদর্শহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। এই যদি রাজনীতিবিদদের মানসিকতা হয়, মুখের ভাষা হয়, তাহলে রাজনীতি নামের শব্দটির সংজ্ঞা বদলানোর সময় বোধ হয় এসে গেছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব রাজনীতিবিদের কাছ থেকে কী শিখবে? রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের কোনো শ্রদ্ধাবোধ কি আর অবশিষ্ট থাকবে?
জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবেএ মাসের ৩ তারিখে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের আগে নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ এবং সংসদ বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তাদের হাতে ক্ষমতা দেন, তারা নতুন নির্বাচন কমিশন করে নির্বাচন করবে—এটাই একমাত্র পথ, আর কোনো পথ নাই। সুতরাং যত দ্রুত পারেন ওই জায়গায় যান।
তা না হলে সালাম সাহেব যেটা বলেছেন, পালাবারও পথ খুঁজে পাবেন না। কারণ এর আগে বলেছি, সময় আর নাই, সময় শেষ হয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, রাজপথে জনগণের বিপুল স্রোত থামানো যাবে না এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেই। এ ছাড়া সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
গত ৬ জুলাই গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১২-দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠকের পর মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের কাছে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং এই সরকারের পদত্যাগ করার ঘোষণা ছাড়া তারা কোনো সংলাপে যাবে না।
পরের দিন গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির সঙ্গে বৈঠক শেষে ফখরুল সাহেব বলেন যে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।
মির্জা সাহেবের বক্তব্যে যাই থাকুক না বা হোক না কেন, তাঁর প্রতিটি বাক্যই অসাংবিধানিক, মানবাধিকারের লঙ্ঘন, জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন, অগণতান্ত্রিক, বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। তাঁর এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? দেশের সংবিধান অনুযায়ী একজন সাধারণ নাগরিকেরও অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। জানি না, আমাদের বিচারব্যবস্থায় এর কোনো বিহিত করার উপায় আছে কি না। তিনি লাগামহীনভাবে যে ধরনের কথাবার্তা বলা অব্যাহত রাখছেন, তাতে মনে হয় না তিনি দেশের আইন-কানুন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, মানবাধিকার বা অন্যের প্রতি সম্মান দেখাতে বিন্দুমাত্র সম্মান দেখাচ্ছেন? এ দেশে রাজনীতি করলেই কি যা ইচ্ছা তাই বলা বা করা যায়?
যাঁরা এ ধরনের উসকানিমূলক, সংবিধানবিরোধী, মিথ্যা, অশালীন, ব্যক্তি-আক্রমণাত্মক ও দলীয় কাঠামো পরিপন্থী কথাবার্তা বলে থাকেন তাঁদের কি রাজনীতিবিদ বলা সংগত হবে? তাঁদের হাতে দেশ পরিচালনার ভার কি করে জনগণ দিতে পারে? ক্ষমতা পেলে নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া দেশ ও জনগণের কল্যাণে তাঁরা যে কাজ করবেন সেই ভরসা যে আর নেই। এ ছাড়া তাঁদের এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বা উসকানিমূলক বক্তব্য যে দেশের আইন পরিপন্থী সে কথাটি কি তাঁরা বোঝেন না? তাঁরা কি জানেন না যে রাজনীতিবিদ কেন, দেশের একজন সাধারণ মানুষও অন্যের সম্মানে আঘাত লাগে এমন বক্তব্য দিতে পারেন না। বিচারের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য দেশের আইন কি তাঁদের সে লাইসেন্স দিয়েছে?
রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন মিথ্যাচারকে পুঁজি করে জনগণকে ধোঁকা দেন, তখন থেকেই মূলত দলের মৃত্যুসনদ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। দলটি হয়ে ওঠে মিথ্যা বলার কারখানা। মিথ্যা নেতৃত্বের বেড়াজালে পড়ে দলের মধ্যে মাতম ওঠে। কিছুটা দেরিতে হলেও জনগণ যখন বুঝতে পারে, তখনই শুরু হয় দলের ও নেতাদের প্রতি অবিশ্বাস, ঘৃণা আর আস্থাহীনতা। সব শেষে দেখা যায়, জনগণ তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমন অবস্থায় দলের লোকজন, বিশেষ করে নেতারা আর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না। অনিবার্য পতন থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য যা খুশি তাই বলে বেড়ান। তাঁদের বোধে আসে না যে এতে তাঁরা আরো ধ্বংসের পথেই নিজেদের ধাবিত করছেন।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অবশ্যই দেশপ্রেম থাকতে হবে। দেশের সম্মানকে সমুন্নত না রাখতে পারলে নিজের সম্মানও ধূলিসাৎ হয়ে যায়, এর চেয়ে সত্য কিছুই নেই। দেশের সম্মান বিকিয়ে দেওয়ার অর্থ নিজের অস্তিত্বকেই মুছে ফেলা। আর সেই কাজটি যখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা সাধিত হয়, তখন লজ্জার আর শেষ থাকে না। যে জাতি তার আত্মসম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই জাতির মতো দুর্ভাগা আর কেউ হতে পারে না। বিএনপি ও তার দোসররা সেই কাজটিই করে যাচ্ছে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে। আসলেই কি ওই সব দলের তথাকথিত নেতারা দেশকে ভালোবাসেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না।
নামমাত্র রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টি নিয়ে যাঁরা রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত করে যাচ্ছেন, তাঁদের দৌড় কতটুকু তা জনগণের জানতে আর বাকি নেই। গত কয়েক বছরে তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হয়েছে। তাই এসব অবান্তর, অরাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সঠিক রাজনীতির পথে না আসতে পারলে জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান ছাড়া কিছু কি পাওয়া যাবে? দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা দলটিকে দিন দিন যে অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছেন, তা ওই সব দলকে প্রতিবন্ধী দলে পরিণত করার ইঙ্গিতই বহন করে। মনে রাখা আবশ্যক, অতীতের মতো তাঁরা আর জোর করে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। ক্ষমতার উৎস জনগণ, তাদের সম্মতিতেই যেতে হবে। গণতন্ত্রের পথে হাঁটুন, জ্বালাও-পোড়াও নীতি পরিহার করুন। দলের ভিত্তি হোক জনগণ, সেই লক্ষ্যে কাজ করুন। সঠিক নেতৃত্বের হাতে দলকে পরিচালনার দায়িত্ব দিন। দলের জন্য নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনৈতিক নেতারা অতি উত্ফুল্ল হয়ে বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে দৌড়ঝাঁপ করছেন। মনে করছেন মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। স্বপ্ন দেখতে কারো খারাপ লাগে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির কোনো শর্তই কিন্তু কারো জন্য শিথিলযোগ্য বলে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এই নেতারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, এসবের প্রতিটি শব্দই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফাইলে নথিভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি হুমকি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, ব্যক্তিগত সম্মানকে আক্রমণ, শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট, উসকানিমূলক বক্তব্য ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো পথ কি তাঁরা খোলা রেখেছেন? তাঁরা তো ধরা পড়ে যাবেন। নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেরাই পড়ে যাবেন। এত পরিশ্রম এবং এই দৌড়ঝাঁপে লাভটা কী হলো? তার চেয়ে এসব বাদ দিয়ে গঠনমূলক ভালো বিষয় নিয়ে ভাবুন, উপকৃত হবেন।
বিদেশিদের কাছে না গিয়ে সরাসরি দেশের মানুষের কাছে যান, কাজে লাগবে। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আমেরিকার কাছে গিয়েছিল। তাতে শেষ রক্ষা হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকাতে পারেনি। যেসব নেতা বিদেশিদের কাছে গিয়ে অবনত মস্তকে নানা রকম অভিযোগ দিচ্ছেন এবং তাদের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে চাইছেন, তাঁরা এসবের মাধ্যমে তাঁদের অসহায়ত্ব বা দেউলিয়াত্বই প্রকাশ করছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশ কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, যে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেমন হস্তক্ষেপ করে না, তেমনি অন্য দেশ তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক তা-ও মেনে নেয় না। এসব বাদ দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ান, তাদের কল্যাণে কাজ করুন। দেখবেন তারাই আপনাদের পাশে দাঁড়াবে, ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে। কারণ জনগণই ক্ষমতার একমাত্র উৎস, বিদেশিরা নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারা আমাদের বন্ধু, উন্নয়নের সহযোগী।
কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা যে মিটিং-মিছিলে অবাস্তব, মিথ্যা, অসম্মানজনক ও উসকানিমূলক বক্তব্য রেখে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন, কিছু লোককে অপরাজনীতিতে নামিয়ে বিপথগামী করছেন, তার দায়ভার কি দলের ওপর বা ওই নেতাদের ওপর বর্তাবে না? রাজনীতির নামে আপনাদের যে জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুরের কর্মকাণ্ড জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে তার হিসাব তো আপনাদেরই দিতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথ তৈরি শুরু হয়ে গেছে, আর জনরোষে পড়ার খুব একটা বাকি নেই। তাই রাজনীতির মাঠ থেকে নির্বাসিত হওয়ার আগেই এসব মিথ্যাচার ও দাম্ভিক বক্তব্য, অপপ্রচার বন্ধ করে নিজেদের সঠিক রাজনীতির ধারায় নিয়ে আসুন। বিশৃঙ্খলা পরিহার করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব। বিকল্প কোনো উপায় নেই।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
মন্তব্য করুন: