প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২৩, ১৬:৪৩
আসন্ন ঈদুল আজহায় আন্তঃদেশীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ও আন্তঃদেশীয় মিতালি এক্সপ্রেস ঈদের আগে-পরে ২৩ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত ১১ দিন বন্ধ থাকবে। এর তাৎপর্য দ্বিবিধ– রেল কর্মচারীদের দিক থেকে এবং রেলযাত্রীদের দিক থেকেও।
আমার পিতা রেলে চাকরি করতেন। স্টেশনমাস্টার ছিলেন। মাতৃকুলের অনেক আত্মীয়স্বজন ছিলেন রেলকর্মী। ছোটবেলায় যখন ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহে ছুটতাম, তখন আব্বা ইউনিফর্ম পরে থাকতেন স্টেশনে। সকালে নর্থ বেঙ্গল মেইল যেত; আমাদের শৈশবের ওই ছোট্ট স্টেশনে ট্রেনটির বিরতি ছিল না। অন ডিউটি স্টেশনমাস্টারকে সবুজ পতাকা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পার করতে হতো মেইল ট্রেনকে।
ছোট নানা ছিলেন লালমনিরহাটে। একবার আমরা ঈদ করতে গেছি লালমনিরহাট। ঈদের দিন সকালে আমরা যখন নিউ কলোনি থেকে রেলবাজার পার হয়ে ওভারব্রিজ পেরিয়ে প্রায় মিছিল করে ঈদগাহে যাচ্ছি, তখন নানার এক সহকর্মী ইউনিফর্ম পরে যাচ্ছেন ডিউটিতে। তিনি যাবেন কুড়িগ্রাম লোকাল নিয়ে। আমরা যখন নামাজে, তখন হুস হুস করে কুড়িগ্রাম লোকাল ছুটল গন্তব্যে।
আমাদের শৈশব কেটেছে পাকিস্তান আমলে। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। তখনও ট্রেন চলেছে ঈদের দিন। ঈদের দিন নামাজ পড়ে মানুষ গেছেন ট্রেনে চড়ে আত্মীয়ের বাড়ি। যাঁদের ছুটিছাটা খুবই কম, তাঁরা নামাজ পড়ে দিনটা কাটিয়ে ফিরেছেন কর্মস্থলে। সড়ক পরিবহন ছিল কম। ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসার স্থল। তাই ট্রেন থাকত ছুটিবিহীন।
এখন দেশে সড়ক পরিবহন যাত্রী বহন করে দেশের আনাচে কানাচে। তাই ঈদের দিন কতিপয় মেইল এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়া আন্তঃনগর ট্রেন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া চলে শুধু শোলাকিয়া ঈদ স্পেশাল। এটা হয়তো মানবিক কারণে। আমার পিতার সমপদে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের এখন ঈদের দিন সকালে মন খারাপ করে সবুজ পতাকা হাতে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে হয় না। ইউনিফর্ম পরে ঈদের সকালে ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয় না দূরের কোনো গন্তব্যে।
সমস্যা হয় অন্যত্র। ঈদের ছুটি মোটে তিন দিন। ঈদের দিন, আগের দিন ও পরের দিন। একজন চাকরিজীবী যদি বাড়তি ছুটি না নিয়ে ঈদে বাড়ি যেতে চান তাঁর জন্য চোখে শর্ষে ফুল, ট্রেনের ছুটি। রেল হয়তো ভাবে, সব যাত্রীকে বহন করার দায় রেলওয়ের নয়। যাত্রীরা না হয় সড়কপথে যাক, বিমানপথে যাক কিংবা নৌপথে। পথ তো খোলা অনেক। রেলের ওপরে নেই ভুবনের ভার!
বিপদ অন্যত্রও। গত ঈদুল ফিতরে ঈদের আগে-পরে মিলে মিতালি এক্সপ্রেস ১০ দিন আর মৈত্রী এক্সপ্রেস ৮ দিন ছুটি ছিল। আন্তঃদেশীয় বন্ধন এক্সপ্রেস ছুটি থাকবে শুধুই ঈদের দিনে ২৯ জুন। এবার যে যুক্তিতে মৈত্রী এক্সপ্রেস ও মিতালি এক্সপ্রেস ১১ দিন বন্ধ থাকছে, নিশ্চয় তার বিপরীত যুক্তিতে আন্তঃদেশীয় বন্ধন এক্সপ্রেস চলবে।
আন্তঃনগর বা আন্তঃদেশীয় ট্রেন ঈদে বন্ধ থাকার পেছনে হয়তো শতকোটি যুক্তি আছে। রেলকর্মীদের হয়তো আবদার আছে। তাঁদেরও তো সাধ-আহ্লাদ আছে। তাদেরও ইচ্ছা করে উৎসবের দিন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কাটাতে। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তাই রেলকর্মীদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে আনন্দঘন পরিবেশে উৎসব পালন করতে।
ট্রেন বন্ধ থাকায় অনেক পরিবারেই আনন্দের সুবাতাস হয়তো বয়ে যায়। কিন্তু আন্তঃদেশীয় মিতালি এক্সপ্রেস বন্ধ থাকায় কাঁদে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মিরিক, শিলিগুড়িসহ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার কয়েক শ বোর্ডিং স্কুল ছাত্রছাত্রী। বাংলাদেশের কয়েক হাজার শিশু-কিশোর-কিশোরী লেখাপড়া করে দার্জিলিং ও এর আশপাশের বোর্ডিং স্কুলে। মিতালি এক্সপ্রেস চালু হওয়ায় পর্যটকরা যতটা না খুশি; তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলেন এইসব পড়ুয়া, তাদের বাবা-মা, অভিভাবক। এই শহরগুলোর নিকটতম শহর শিলিগুড়ি। মিতালি এক্সপ্রেস চলাচল করে এই শিলিগুড়ি শহরছোঁয়া নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন থেকে। একেবারে তাদের হাতের নাগালে রেলস্টেশন; বাড়ি আসার ট্রেনের ঘাঁটি।
এই পড়ুয়ারা একা চলাচল করতে পারে না বয়সের কারণে। তাদের বাবা-মা বা আইনানুগ অভিভাবকদের ভারতে গিয়ে তাদের নিয়ে আসতে হয়। বাবা-মা চাইলেই ঈদের অনেক আগে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে আসতে পারেন না। তাঁদেরও ছুটিছাটার ব্যাপার আছে। গত ঈদুল ফিতরে ট্রেনের ছুটি থাকায় সহজ পথের নাগাল না পেয়ে অনেক পড়ুয়াকেই দেশে আসতে হয়েছে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ঘুরে। শিশু-কিশোরদের ভোগান্তির এক শেষ। তাদেরকে আনতে যাওয়া অভিভাবকদেরও কম নাকাল হতে হয়নি। ঈদের আগে-পরে আন্তঃদেশীয় ট্রেনের ছুটির কারণে এসব শিক্ষার্থী, সেই সঙ্গে তাদের বাবা-মাকে অশ্রুপাত করতে হয়েছে ঈদের আনন্দের সময়ে।
রেলওয়ে তো রাষ্ট্রীয় পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান। ট্রেনের ছুটি মানে রেলকর্মীদের ছুটি। খুবই মানবিক। রেলওয়ে ছাড়া দেশের আর কোনো রাষ্ট্রীয় পরিষেবা দানকারী ঈদের দিনে ছুটি পায়? ‘মানবিক’ কারণে রেলওয়ের কর্মীরা ছুটি পেলে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন– বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল, পুলিশসহ আরও অনেকেরই তো ওই দিন ছুটি পাওয়া উচিত।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল, পুলিশসহ যাদের ছুটির কথা তোলা হলো, তাদের ছুটি ভাবনারও অতীত। বরং তাদের আরও বেশি সক্রিয় থাকতে হয় ঈদের দিন। আগে থেকে কেউ ছুটিতে থাকলে তা-ও বাতিল করা হয়। পরিষেবা প্রদানকারী এসব প্রতিষ্ঠানের ছুটি যেমন বিপর্যয় ডেকে আনবে দেশের, তেমনি বিপর্যয় হয় রেল বন্ধেও। হয়তো এই বিপর্যয় সারাদেশে সবাইকে একসঙ্গে ছোঁয় না। তবে যাদের ছোঁয় তাঁরা বোঝেন সেই বেদনা।
রাষ্ট্রীয় পরিষেবা দানকারী রেলওয়ের পরিষেবা চালু থাকুক অষ্টপ্রহর, প্রতিদিন। ঈদের মতো উৎসবের দিনে রেলকর্মী ও যাত্রীদের যাতে ধর্ম পালনে বিঘ্ন না হয়, সে জন্য ট্রেনের বিরতি নামাজের সময় ঘণ্টা দেড়-দুই হতে পারে। না হয় কর্মীদের এক দিনের বাড়তি বেতন দেওয়া যেতে পারে। তবুও ঈদের দিন চালু থাকুক সব ট্রেন। লোকাল, মেইল এক্সপ্রেস, আন্তঃনগর বা আন্তঃদেশীয়– সব ট্রেন চলুক ঈদের দিন। ঈদে রেলগাড়ির কোনো ছুটি নয়।
আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
saislach@gmail.com
মন্তব্য করুন: