প্রকাশিত:
১৯ জুন ২০২৪, ১৮:০১
সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন। জেলায় ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। সময় যত যাচ্ছে, আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার ৪টি পৌরসভা ও ৭৪টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। ১ হাজার ১৮টি গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় পানি বেশি উঠেছে। (১৮ জুন) মঙ্গলবার রাত থেকে জেলার শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় পানি বেড়ে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব উপজেলায় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। জেলার মোট ৫৪১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবন, ব্যক্তিমালিকানা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ইতিমধ্যে ১৮ হাজার ৪২৯ জন বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ছাতক উপজেলায়। এই উপজেলা এক সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত। এখানে ৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা ও রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে।
ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম মুস্তাফা বলেন, ‘কোনো কোনো এলাকায় পানি কমছে, আবার কোথাও বাড়ছে। বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন। আমরা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা বিতরণ করছি।’
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের (ছাতক ও দোয়ারাবাজার) সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় বন্যার প্রকোপ বেশি। আমরা মঙ্গলবার দিনভর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার বিতরণ করেছি। যেখানে যা করা দরকার প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাই মিলে আমরা করব।’
দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আছেন। এই উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোয়ারাবাজারের ইউএনও নেহের নিগার তনু বলেন, ‘আমরা মানুষের পাশে আছি। যেখানে যা দরকার সেটি করার চেষ্টা করছি। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।’
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন। শহরের প্রায় সব কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি অফিস, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন, বাড়িঘরেও মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
শহরের ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের বনানীপাড়া, বলাকা, ষোলঘর ও হাসননগর এলাকার শতাধিক পরিবার। সেখানে মঙ্গলবার (১৮ জুন) সকালে বনানীপাড়ার শ্রমিক নাসির উদ্দিন আশ্রয় নিয়েছেন পরিবারের চারজন সদস্য নিয়ে। আজ বুধবার সকাল নয়টায় নাসির বলেন, ‘ঘরে কোমরপানি, বাচ্চারা ভয় পায়। তাই চইলা আইছি।’ একই এলাকার ইয়াসিন মিয়া বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে একদল তরুণ কিছু খাবার দিছিল। আর কোনো কিছু এখনো পাই নাই আমরা।’ হাসননগরের রেজিয়া বেগম বলেন, ‘পানি বাড়ের। মানুষ আরও আইরা। পরতি বছর আমরা গজবও পড়ি।’
এদিকে সুনামগঞ্জ শহরের বেশির ভাগ এলাকাই বন্যাকবলিত। অনেক রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে বন্যার পানি রয়েছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় মানুষ চরম দুর্ভোগে আছেন। আজ সকালেও মানুষের ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি দেখা গেছে। শহরের ষোলঘর, নবীনগর, বড়পাড়া, মল্লিকপুর, ওয়েজখালী, ফিরোজপুর, উকিলপাড়া, মুক্তারপাড়া, হাজীপাড়া, আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, নতুনপাড়া, কালীপুর সমবায় সুপারমার্কেট, মধ্যবাজার, পশ্চিমবাজার এলাকাতেও বন্যার পানি রয়েছে। এসব এলাকায় অনেক দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি আজ সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। দুপুর ১২টায় এখানে পানি আরও ২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ছাতক উপজেলা সদরে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জে মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে (আজ) ১৯ জুন বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। তবে এখানে বৃষ্টি কম হলেও সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে উজান থেকে ব্যাপক পরিমাণে সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল নামছে।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, সুরমা নদীর পানি কোনো কোনো স্থানে সামান্য কমেছে। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী, অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পানি আরও বাড়তে পারে। যদি উজানে বেশি বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার, রান্না করা খাবার বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ত্রাণসামগ্রীর জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
মন্তব্য করুন: