প্রকাশিত:
২৭ আগষ্ট ২০২৪, ১১:৩১
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের জন্য নেওয়া ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০২২ সালে। দুই বছরে প্রকল্পটির ১ শতাংশ কাজও করা সম্ভব হয়নি। দুই বছর পর এখন নানা কারণ দেখিয়ে প্রকল্পটির ব্যয় ৯১ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিটিসিএল।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) রুশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও অন্যান্য কার্যক্রম করার কথা ছিল। কিন্তু বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করার জটিলতার কারণে চুক্তি করা যায়নি। এতে প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়নি।
সম্প্রতি এই বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধনীর ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। গত ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত হওয়া এই পিইসি সভা সূত্রে জানা যায়, বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অত্যাধুনিক ও উচ্চগতিসম্পন্ন এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বাস্তবায়নাধীন ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রকল্পটি তড়িঘড়ি করে অনুমোদন নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত রাশিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো চুক্তিই করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিটিসিএল। এ ছাড়া ২০২২ সালে যখন প্রকল্পটি অনুমোদন পায় তখন ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ টাকা, যেটি চলতি বছর পর্যন্ত বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে।
এ ছাড়া কোনো কাজ না করেও এখন বিভিন্ন খাত যোগ করে এর ব্যয় প্রায় শতভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটি মোট ৩৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে চলতি ২০২৪ সালের মার্চে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মার্চ মাস শেষে ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় মাত্র চার কোটি ৮২ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব, উভয় ক্ষেত্রে অগ্রগতি মাত্র ০.০১ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দসহ চলমান প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রকল্পটি ১ শতাংশও বাস্তবায়ন না করে বর্তমানে এর ব্যয় ৩৪৫ কোটি টাকা (৯১.০৫ শতাংশ) বাড়িয়ে মোট ৭২৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদও আরো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি না হওয়া প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, প্রকল্পের নেটওয়ার্ক ডিজাইন চূড়ান্তকরণে রাশিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক ফি পরিশোধে আরোপিত শর্তগুলো পরিপালন করা সম্ভব না হওয়ায় ক্রয়সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া সম্পাদন সত্ত্বেও চুক্তি করতে না পারায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। ফলে এই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, প্রকল্পে তিনটি এনটিটিএন অপারেটর থেকে আইআরইউ ভিত্তিতে অপটিক্যাল ফাইবার লিজ নেওয়া বাবদ চাহিদাকৃত বাস্তব ব্যয় অনুমোদিত ডিপিপিতে বর্ণিত প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, চাহিদা, কারিগরি ও সেবাজনিত কারণে টেলিকম সরঞ্জাম ও সিকিউরিটি ইকুইপমেন্টের বিভিন্নতায় ও সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। এনপিপির জন্য সিকিউরিটি বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে সব লেয়ারে নতুন করে সিকিউরিটি যন্ত্রপাতি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল ডিপিপিতে ছিল না।
সংশোধিত প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের তুলনামূলক ব্যয় সারসংক্ষেপে খাতগুলোর সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত একক ও পরিমাণের উল্লেখ না থাকায় তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প অনুমোদনের হার বেড়েছে গত কয়েক বছরে। দুর্নীতি করতে অতিরিক্ত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারা বা দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো; প্রকল্প বাছাইয়ে দুর্বলতা কিংবা কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারা বা প্রকল্পের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে না পারাসহ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অনিয়ম বর্তমান সময়ে বেশ আলোচিত। অনেক প্রকল্পে এসব অনিয়মের শুরু হয় বিধান ভেঙে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কিংবা যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে তা অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে।
এর আগে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ‘বালিশকাণ্ড’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেখানকার বিছানা, বালিশ ও আসবাব কেনায় মালপত্রের প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়। ওই ঘটনায় প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১৬ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও বিল প্রদানের সঙ্গে জড়িত ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়।
মন্তব্য করুন: