প্রকাশিত:
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:১৫
কারো পুড়েছে বাড়ি, কারো ভেঙেছে ফ্রিজ ও আসবাবপত্র। এভাবে কমপক্ষে ৫০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব বাড়ির লোকজনের বেশির ভাগেরই তিন বেলা খাওয়া হয়নি গত শনিবার থেকে। নিজেদের বাড়ি হারিয়ে অন্যের বাড়ি থাকছেন। সাংবাদিক এসেছে শুনে কাঁদতে কাঁদতে পোড়া বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করছেন।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) গিয়ে দেখা গেল নড়াইলের কালিয়া উপজেলার খাশিয়াল বাজারের পাশেই জাফর বিশ্বাসের বাড়ির কয়েকটি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগুনে গাছের পাতা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বই-খাতাসহ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। একটু পরেই জাফর বিশ্বাসের দুই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকলেন।
ছোট মেয়ে সুমাইয়া গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি অভিযোগ করলেন, পুলিশের সামনেই আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিল, আমার সমস্ত বই-খাতা, সনদ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
খাশিয়াল গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য জাফর মোল্যা ও একই গ্রামের আব্দুল ওহাব শেখ গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছে। এরই জেরে চলছে পাল্টা-পাল্টি সংঘর্ষ, হামলা। গ্রাম্য দুটি গ্রুপের মধ্যেই বিভিন্ন দলের সমর্থক রয়েছেন।
খাশিয়াল গ্রামের জাফর বিশ্বাস ছাড়াও আগুনে পুড়েছে গ্রুপের প্রধান সাবেক ইউপি সদস্য জাফর মোল্যা, চঞ্চল শেখ, আইয়ুব মোল্যা, শওকত শেখ, মুকুল শেখ, আতাউর শেখ, আশরাফ শেখের বাড়িসহ অন্তত ৫০টি বাড়ি। এসব বাড়ির পুরুষেরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে আছেন।
নিজের একমাত্র বসতঘরটি পুড়িয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। ঘরের টিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে, কোথাও কোন ভালো চিহ্ন নেই। ঘর হারিয়ে উত্তর পাড়ার আমেনা বেগম গর্জে উঠলেন। বললেন, আমি আমার ছোট বাচ্চা নিয়ে কোনো রকমে ঘর থেকে বের হইছি। আমার কোনো থাকার জায়গা নাই। আল্লাহ আমার ঘর যারা পুড়াইছে তাদেরও যেন সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাশিয়াল গ্রামের আব্দুল ওহাব শেখ ও জাফর মোল্যা গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছে। চলতি ঘটনার শুরু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে খাসিয়াল গ্রামের ওসিকুল নামের এক জামায়াত কর্মী ছিলেন। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডায় ৯ আগস্ট তাকে মারধর করেন জাফর মোল্যা গ্রুপের লোকজন। এর জের ধরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর আব্দুল ওহাব শেখের লোকজন জাফর মোল্যাকে কুপিয়ে জখম করেন।
এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন জাফর মোল্যার লোকেরা। শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাফর মোল্যার লোকজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ুয়া মিলন শেখকে কুপিয়ে হাত ও পায়ের আঙুল কেটে ফেলেন।
শুক্রবার রাতেই দুই পক্ষ ঘোষণা দিয়ে শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চাইলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তা থেমে যায়। ওই দিন সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানে দেশীয় অস্ত্র ও একটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিন বিকেলে নড়াগাতি থানা পুলিশ ও দুজনকে আটক করে।
সেনাবাহিনী এলাকা থেকে চলে যাওয়ার পরপরই সকাল ১১টা থেকে আব্দুল ওহাব শেখের লোকেরা জাফর মোল্যা গ্রুপের খাশিয়াল উত্তর পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। ভাঙচুর চলে রাত অবধি। এলাকার লোকেরা ভয়ে এ ঘটনায় কোনো মামলা করেননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন শেখ ছাত্রদল করেন। তার আঙুল কেটে ফেলায় পরিবারে চলছে হতাশা। বৃদ্ধ বাবা আবু হানিফ শেখ ছেলের পঙ্গুত্বের জন্য কাঁদছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মিলনের হাত ও পায়ের সবগুলো আঙুলই কেটে ফেলেছেন প্রতিপক্ষের লোকেরা। বর্তমানে তিনি ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মিলনের মেজ ভাই চুন্নু শেখ বলেন, ঢাকায় আন্দোলন করেছে আমার ভাই। সে সেখানে সহ-সমন্বয়ক ছিল। সে কোনো গ্রাম্য কোন্দলে জড়িত না। আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই বিদেশে থাকি। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কমপক্ষে ২৯টি কোপ দিয়েছে প্রতিপক্ষের লোকজন। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে আপনারা জড়িত কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভাইকে চিকিৎসা দিতেই ব্যস্ত। তবে শুনেছি মিলনের এমন অবস্থা দেখে ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে।
নড়াগাতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশের সামনে ঘটেছে এটা ঠিক নয়, সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পরে আগুন আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। তারা কোনো অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন: