প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:০৫
বাংলা প্রতিবাদী কাব্যধারায় এক অনিবার্য নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উত্তাল কালপর্বে আবির্ভূত এই কবি তার কাব্য যাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’ এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’-এ। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।
বাংলা সাহিত্যের দ্রোহ এবং প্রেমের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ৬৮তম জন্মদিন আজ।
১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর তার পিতার কর্মস্থল বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তার মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে।
কবি রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এম এ পাশ করেন। ঢাকা ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অবৈধ সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন রুদ্র।
তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকয়টি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণ-আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং `ভালো আছি ভালো থেক`সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
কবির কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে,
উপদ্রুত উপকূল(১৯৭৯),ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম(১৯৮২), মানুষের মানচিত্র(১৯৮৪), ছোবল (১৯৮৬), দিয়েছিলে সকল আকাশ(১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)।তিনি ১৯৮০ সালে শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ও চলতি বছর একুশে পদক(মরণোত্তর)লাভ করেন।
নিজেকে ‘শব্দশ্রমিক’ হিসেবে ঘোষণা করা এই কবি কবিতার ক্ষেত্রে নিবিড় নিরীক্ষাপ্রিয়। ব্যক্তিজীবনে উচ্ছন্নতা থাকলেও কবিতার প্রতি তিনি ছিলেন প্রগাঢ় নিষ্ঠাবান।তার মনন ছিল সর্বভুক। তার চিন্তা ছিল নৈর্ব্যক্তিক। তার কর্ম ছিল পরিমাপহীন। তিনি ছিলেন সেই মানুষ যিনি বাংলাদেশকে দেখতে চেয়ে ছিলেন সুখী-সমৃদ্ধির দেশ।তিনি কবিতাই লিখতেন না শুধু তিনি কবিদের সংঘবদ্ধ হতেও আগ্রহী করতেন।
ব্যক্তিজীবনে বাউন্ডুলে এ কবির জীবনে বন্ধু ছিলো অসংখ্য। অনেক ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তসলিমা নাসরিনকে, ১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারি। তখনো তসলিমা নাসরিন নামে খ্যাতি পাননি। সে বিয়ে টেকেনি। ১৯৮৮ সালে তাদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। অবশ্য ৯০’র শেষদিকে তসলিমার সঙ্গে আবার প্রেম শুরু হয়েছিলো। কিন্তু সেটা ছিলো তসলিমার দ্বিতীয় বিবাহ থেকে তৃতীয় বিবাহে উত্তরণের মধ্য সময়ে। ফলে সে প্রেমও টিকলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্যামা তরুণী শিমুলের সঙ্গে প্রেম হলো। কিন্তু তার অভিভাবক রাজী না। সে সম্পর্কও চুকে বুকে গেলো।
সেই থেকে রুদ্র আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে লাগলেন। ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যেতে লাগলেন। ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শরীরের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার শুরু করেন। প্রচুর ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম—সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। শারীরিক অসুস্থতাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন না। অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন।কবির অগণিত বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও এই সময়টায় তিনি অনেক বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। একদিন গুরুতর অসুস্থ হলে কবির স্থান হয় হলি ফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে। হাসপাতালে সপ্তাহখানেক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০ জুন রুদ্র বাসায় ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে না ফেরার দেশে পারি জমান কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
ওপারে কবি ভালো থাকুক প্রিয় কবি,তাঁর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মী
মন্তব্য করুন: