গল্পটা বহু বছর আগের ১৯৮৪ সালের, যখন আমি মাস্টার্স করতে লন্ডনে গিয়েছিলাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের মত বিদেশ সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। হ্যাঁ, আমার বাবা অফিসের কাজে বিদেশে গেছে সে ছবি দেখেছি, টিভিতে বিদেশি জীবন যাপন সম্পর্কে সে ও সামান্যই দেখেছি, এর বেশি কিছু না। কিন্তু পড়াশোনার খাতিরে নিজেকে যখন একা বিদেশে পাড়ি দিতে হলো তখন সত্যি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
প্রথম দিনেই বিপত্তি। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলাম লন্ডন স্কুল অফ হাইজিনে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে, তারা পই পই করে বলে দিয়েছিল এয়ারপোর্টে লোক আসবে আমাকে নিতে, তার হাতে আমার নাম লেখা একটা প্ল্যাকার্ড থাকবে। কিন্তু আমার সুরক্ষার জন্য আমার বাবা-মা এতই বিচলিত ছিল যে এক পরিচিত পরিবারকে এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে অনুরোধ করল। আমিও এমন বোকা, হিথ্রো এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নেমে তাদেরকে দেখে বেমালুম ভুলে গেলাম যে ফর্মালি কেউ নিতে আসবে, আমি দিব্যি পরিচিত মানুষের সাথে তাদের বাসায় চলে গেলাম। যাদের বাসায় গেলাম তারা আমাকে ছোটবেলা থেকে বড় হতে দেখেছে, আদরে গলে গেলাম।
এদিকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে রিপোর্ট হয়ে গেছে যে আমি পৌঁছাইনি। অনেকক্ষণ পরে আমার টনক নড়লো, ফোন করে লন্ডনের ব্রিটিশ কাউন্সিকে জানালাম যে আমি আমার আত্মীয়র বাসায় এসেছি। তারা তো ক্ষেপে আগুন, বলল "তুমি কি জানো তোমার জন্য যে আমরা কোলচেস্টারে একটা থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি, সেখানে পৌঁছানোর জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছি"? আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে, বুঝলাম বড় ভুল করে ফেলেছি। বললাম ট্রেনের টাইম বলুন আমি স্টেশনে যাচ্ছি। যাই হোক, যে বাসায় উঠেছিলাম সেই বাসার ভদ্রলোক বললেন আমার তো কাজ আছে নাহলে তোমাকে পৌঁছে দিতাম।
আমার সেজ চাচা লন্ডনে থাকতেন, ইনি কাজ ফেলে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনিও জানালেন যে তার পক্ষে সম্ভব হবে না আমার সাথে কোলচেস্টার পর্যন্ত যাওয়া। হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলাম নিয়মের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া বুদ্ধুর মতো কাজ এবং আরো একটা জিনিস আত্মস্থ করলাম যে ওখানে সবাই যে যার কাজের জন্য অত্যন্ত অকুপাইড, দেশের মতো পরিস্থিতি নয় যে নিজের কাজ কাটছাঁট করে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে। আমার চাচা আমাকে মালপত্রসহ স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসলো। তখনকার দিনে হালকা সুটকেস গুলো পাওয়া যেত না।
বিশাল ভারী সুটকেস, দুটো হাত ব্যাগ, কাগজপত্র সবকিছু নিয়ে আমি ট্রেনের অপেক্ষায়। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক স্টেশনে আসলেন, আমাকে বলা হলো এক মাস থাকতে হবে কোলচেস্টারে একটা বিদেশি পরিবারের সাথে। সেদেশের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্য নাকি এই ব্যবস্থা। সাথে সাথে একটা লার্নিং সেন্টারে ও হাজিরা দিতে হবে প্রতিদিন। ব্রিটিশ কাউন্সিল তখন বিদেশি স্টুডেন্টদের জন্য এই ধরনের ব্যবস্থা করত।
আমাকে জানানো হলো ট্রেনে এক ঘন্টার মত লাগবে পৌঁছাতে। প্রতি স্টেশনে ট্রেনের সকল দরজা অটোমেটিক খুলবে না।সেক্ষেত্রে আমাকে ভিতর থেকে লক খুলে বেরোতে হবে। ট্রেনে মালপত্র রাখার জন্য আলাদা স্পেস আছে। স্টেশনে দুই মিনিট ট্রেন থামবে। আমি ভাবলাম দুই মিনিটের মধ্যে মালপত্র নিয়ে লক খুলে কেমন করে আমি স্টেশনের নামবো? যাইহোক, ট্রেনে উঠে আমি আমার পাশে বসা এক মেয়ের সাথে গায়ে পড়ে আলাপ করলাম, বললাম দেখো আমি এখানে নতুন এসেছি, কোলচেস্টার স্টেশনটি আসার আগে আমাকে একটু রিমাইন্ডার দিতে পারবে? সে আমাকে আশ্বস্ত করলো। নিজেকে বাহবা দিলাম লটবহর নিয়ে ঠিক স্টেশনে নামতে পারার জন্য।
কোলচেস্টারএকটা শহরতলী বলা যেতে পারে, খুব ভালো লেগে গেল। যে বাসায় থাকলাম তিনি একজন নার্স, মিস স্পেনি, নিজে হাতে আমার ভারী সুটকেস দোতালায় তুলে দিলেন। রুম দেখে তো আমি অভিভূত, পর্দা থেকে শুরু করে স্যাটিনের বেডকভার সবকিছু গোলাপি ও সাদা লেস দিয়ে সাজানো। জানালা দিয়ে দেখা যায় সুন্দর লন যেখানে একটি ছোট্ট পুকুর আর আর্টিফিশিয়াল পাখির বাসা, অতিথি পাখির জন্য। গাছে গাছে ঝোলানো রয়েছে নেটের পাউচের ভেতরে পাখির খাবার যাতে অচেনা পাখি এসে খেয়ে যেতে পারে। পরে শুনেছিলাম ওটা স্পেনির মাস্টার বেডরুম। আমাকে বিদেশি মহিলা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি ভাবলাম একজন ডাক্তার আসছে আমার বাসায় থাকতে, তার তো অনেক স্পেস দরকার হবে তাই আমি রেগুলার যে রুমগুলো ভাড়া দেই সেখানে ব্যবস্থা না করে নিজের বেডরুমটা প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি তো দেখছি ছোট্ট একটি মানুষ। আসলেও তখন আমি রোগাপটকা ছোটখাটো একটা মানুষ ছিলাম।
দিন যায়, লার্নিং সেন্টারে ভালই লাগছিল বিভিন্ন দেশের স্টুডেন্টদের সাথে ইন্টারেকশন করে, লার্নিং টেকনিক শিখছিলাম, উইকেন্ডে বেড়ানো হচ্ছিল আসেপাশের বিভিন্ন জায়গায়। বিদেশি মহিলা বুঝতে পারছিলেন আমার খাওয়া দাওয়ার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। তিনি ইন্ডিয়ান রেসিপি ঘেঁটে আমার জন্য একদিন অরেঞ্জ কালারের একধরনের ভাত রান্না করলেন। আমি বুঝলাম ফুড কালার দিয়ে ভাতের এই অবস্থা হয়েছে, বললাম খুব ভালো হয়েছে। উনি বললেন তুমি যদি ঠিকমত না খাও তোমার মা তো তোমার ছবি দেখে বলবে আমি তোমার যত্ন নেইনি। বিদেশী একটা মানুষের এত স্নেহ পেয়ে মনটা বিগলিত হয়ে গেল।
সেদিন ছিল উইকএন্ড, স্পেনি আমাকে বলল দেখো আমি তো আমার বোনের বাসায় বেড়াতে যাব, আর আমার কুকুরটাকে আমি উইকন্ডে বাসার ভিতরে ছেড়ে রাখি, সে একটু রাগী ধরনের, তুমি কি একটু বাইরে কোথাও কাটাতে পারবে দিনটা। সর্বনাশ! সারাদিন আমি কোথায় থাকবো? কি খাব? কি আর করা, পার্কে ঘুরে বেড়ালাম, একটা পুরনো ক্যাসেল ছিল, সেটা দেখলাম আর উইন্ডো শপিং করলাম, এটা সেটা কিনে খেলাম। তবু দিন আর কাটে না। পার্কে বয়স্ক মানুষরা সারাদিন বসে থাকে কারণ তাদের ফ্যামিলি তাদের সাথে থাকে না। আমি এমনই এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। উনি বাঙালি মেয়ের লম্বা চুল দেখে বেশ অবাক হলেন। বললেন তুমি এতোটুকু একটা মেয়ে ডাক্তার হয়েছো আবার এত দূরে এসেছ পড়াশোনা করার জন্য? তোমার পড়াশোনার জন্য এত আগ্রহ! আমি তাকে কি করে বোঝাই এটা আগ্রহ নয় রে ভাই চাকরির রিকোয়ারমেন্ট।
পরবর্তীতে লন্ডন স্কুলে এক বছর পড়াশোনা করেছি, আমার মেডিকেল কলেজের এক বন্ধুকে সেখানে খুঁজে পেয়েছি, দেশের দুই জন ক্লাসমেট পেয়েছি, অনেক কিছু দেখেছি, সে এক অন্য কাহিনী। তবে কোলচেস্টার এর ঢালু ঘনসবুজে ঘেরা নির্জনরাস্তা,নরম সুন্দর আবহাওয়া, সাধারণ মানুষের বিদেশিদের প্রতি আন্তরিকতা আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত স্টুডেন্টদের সাথে মিশতে পারার প্রথম অভিজ্ঞতা আমি সারা জীবনে কখনো ভুলিনি।
মন্তব্য করুন: