প্রকাশিত:
২৩ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৪৫
নতুন বৌ হয়ে যখন মিনু এলো এ বাড়িতে, পরদিন থেকেই কোমরে আঁচল জড়িয়ে নেমে পড়লো সংসারের কাজে। একেতো নতুন বাড়ি, তার উপর পুরোই ফাঁকা।
শ্বশুর শাশুড়ির বরন ডালা জুটলো না তার ভাগ্যে। পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ পুত্রের বধু হয়ে মিনুর যখন আগমন ঘটলো, শ্বশুর শাশুড়ি তার বহু আগেই বিদায় নিয়েছেন জগত সংসার থেকে। ভাসুর ননাসদের আপন আপন গন্ডিতে আপন আপন সাজানো সংসার। আপ্যায়নের কোন ত্রুটি নেই, নেই আন্তরিকতারও। কিন্তু যৌথ পরিবারের মত এক হাঁড়ির অন্নে অনেকগুলো ভাইবোনদের যে বাড়তি আনন্দের একটা ব্যাপার থাকে, মিনুর কল্পনায় তা অপুরনীয়ই রয়ে গেলো। নিজে একক পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় খানিকটা স্বপ্ন ছিল বৈকি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গ উপভোগের। কিন্তু আশায় গুড়েবালি।
পৈত্রিক ভিটা থেকে বেশ কিছুটা দূরে শহরের আরেক প্রান্তে মিনুর হাসবেন্ড ছোট্ট খাটো একটা দ্বিতল বাড়ি সম্পন্ন করে তবেই বিয়ের পাত্র সেজেছেন। সদ্য নির্মিত বাড়িটিতে নববধূ মিনুও নতুন সাজে সাজিয়ে চলেছে ।দোতলার ব্যালকনিতে গোটা কতক ছোট ছোট টবের গাছ শিকায় ঝুলাতে গিয়ে সামনের বাড়িটির খোলা আঙ্গিনায় দৃষ্টিটা আটকে যায়। পিঠ ছড়ানো এলো চুল পড়ন্ত বেলার নরম রোদে ছড়িয়ে বিস্ময়ের চাহনী মেলে তাকেই দেখছে একটি মেয়ে। কি যে মায়াময় চোখের চাউনি। চাপা গায়ের রঙ ঠেলে অপরূপ শ্রীময়ী মুখখানা। কমনীয় ঢলোঢলো মুখাবয়বে জ্বলজ্বল করছে লাল পাথরের নাকফুল।
গ্রীলের ফাঁকে মুখ লাগিয়ে সৌজন্যের হাসি দেয়। মেয়েটিরও চিকন দুঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
শহুরে পরিবেশে একটা গ্রামীন ভালোলাগা ছুঁয়ে দেয় যেন মিনুকে।
ধীরে ধীরে প্রতিবেশিদের অনেকের সাথেই আলাপ হয়, হয় সখ্যতাও।
দূর থেকে দেখা মেয়েটাকেও জানা হয়। নাম শেফালি।বয়সে ওর বেশ ছোটই হবে। বিয়ে হয়েছে মাস কয়েক আগে।
একই শহরের এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির আশ্রিতা হয়েছে। তবে আগের বাড়িতে ছিল সংগিহীন, এখানে সংগীসহ।
কোন ছেলেবেলায় গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল ওদের গাঁয়ের চৌধুরী সাহেব তার মেয়ের বাড়িতে। সাহায্যকারী হয়ে থাকবে, কাজ কর্ম শিখবে। মাসে মাসে মায়ের কাছে হাতখরচটাতো যাবেই, উপরন্তু বিয়ের জন্য যা যা ব্যয়ভার সব দায় ওদেরই রইবে।
শেফালির বিধবা মা অনেক ভেবে রাজী হয়েও গেলেন, কন্যার ভবিষ্যৎ দায় মুক্তির আশায়।
বেগম সাহেবা মানুষটিও মন্দ ছিলেন না। কথা রেখেই এগুচ্ছুলো সময়। সাহায্যকারী থেকে সংসারের পুরো দায় শেফালি কাঁধে নিলো নিজ দক্ষতায়। তার উপরেই পুরো নির্ভরশীল হয়ে গেলেন কর্ত্রী একসময়।
কিন্তু চারপাশ ঠিক থাকলেও মনের একান্ত ছোট্ট কোনটুকুতে বাঁধলো গন্ডগোল। ওখানে আর নিজের নিয়ন্ত্রন নেই শেফালির। কখন কোনদিন যে ওর মন পুরোটাই বেদখল হয়ে গিয়েছে নিজেও জানে না। যখন জানলো বিনা বাক্যব্যয়ে এতদিনের আশ্রয় ছেড়ে মানুষটির হাতে হাত রেখে বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন এর কাগজে সীল ছাপ্পড় দিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে নতুন পরিচয়টা মাথা পেতে নিলো।
শেফালি আর ফিরলো না পুরনো ঠিকানায়। নতুন আশ্রয় জুটে নতুন মানুষের ঠিকানায়, এটাইতো জানে সে। মানুষটিও যে এ শহরে আশ্রিত। শেফালির ঐ বাড়ির বেগম সাহেবার আত্মীয়ের বাড়ি সেটা। এ বাড়ি ও বাড়ির এটা সেটা আদান প্রদানে এবেলা ও বেলা আসার সুত্র ধরেই মানুষটির প্রতি ভাব ভালোবাসার উৎপত্তি শেফালির।
এ বাড়ির মালিক মুটামুটি স্বচ্ছল ব্যবসায়ী। এটারই দেখভাল করে শেফালির মানুষটি বহুদিন যাবৎ। নীচতলার পুরোটাই এসব কাজের গুদাম ঘর আর জনা কতক শ্রমিক গোছের পরিশ্রমী মানুষের ঢালাও থাকা খাওয়ার ব্যবস্হা। তারই এক পাশে রান্নাঘর,ভাড়ার ঘর লাগোয়া ঘরটিতে শেফালির নতুন জীবনের শুরু।
বৌ নিয়ে যখন ও বাড়িতে ওঠলো মানুষটি অন্যান্য শ্রমিক বা বাড়ির কেউ তেমন অবাক হলো না। যেন এমনই কথা ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা ঘোলাটে হলো তখনই যখন শেফালি মানুষটির আহ্বানে পিছু পিছু এ বাড়ির কর্ত্রীকে সালাম করতে গেলো দোতলায়।
------- কে? শেফালি না?
ভুত দেখার মত চমকে ওঠলেন এ বাড়ির বেগম সাহেবা। আত্মীয়তার সুত্রে ও বাড়িতে যাতায়াত।শেফালি বহু আগে থেকে চেনা। শেফালির মানুষটি উনাদের বেতনভুক কর্মচারী। জিজ্ঞেস করলেন,
----শেফালিকে বিয়ে করেছো, তোমার বউ জানে?
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো শেফালির। সব্বোনাশ। এত বড় প্রতারণা করলো মানুষটি তার সাথে?
অগত্যা ফয়সালা হলো দুই বাড়ির সাহেব আর বেগম সাহেবাদের আলোচনার মাধ্যমে।
গাঁয়ের বাড়িতে বড় বউ যেমন ছিল তেমনি থাকবে, এখানে থাকবে শেফালি।
আগের বাড়ির মত এ বাড়িরও যাবতীয় দায় দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিলো শেফালি। হা ভাগ্য। বাড়ি বদলালো, কপাল বদলালো না। পিছন ফেরার সব পথই যে বন্ধ। একটু একটু করে অল্পে খুশি হওয়া সারল্যে ভরা মনটা একসময় সুখেই ভেসে বেড়াতে লাগলো। ভুলে গেলো মনের মানুষটির প্রতারণা, বিশ্বাস জন্মানো ভালোবাসায় তার নিশ্চিন্ত অবগাহন হলো নির্দ্বিধায়।
এসব জেনে মিনুর কেমন যেন মায়া জাগে শেফালির জন্য। যতবার ব্যালকনিতে দাঁড়াতো, সামনে বাড়ির খোলা আঙিনায় অনেকের ভীড়ে শেফালিকেই খুঁজতো। আর চোখ পড়লে মায়াবী মুখটা দেখে একই মুগ্ধতায় বিভোর হতো বারবার।
কিছুদিন পর। মিনুর মাতৃত্বের নতুন আয়োজন তখন। বাবার বাড়ি থেকে নিতে এসেছে মিনুকে। লম্বা সময় কাটিয়ে ফিরবে মিনু নতুন মেহমান নিয়ে। যাবার বেলায় দাঁড়ালো ব্যালকনির পূব কোনে, মানিপ্লাটের শিকায় ঝোলানো পাতাগুলো ছুঁয়ে দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে খুঁজে পেলো শেফালিকে। এক গাদা কাপড় ভিজানো গামলা নিয়ে বসেছে মোড়া টেনে। খানিকটা ক্লান্তও দেখাচ্ছে ওকে।
বরাবরের মত চোখে চোখ পড়তেই মিনু জানালো কিছুদিনের অনুপস্হিতির খবরটা। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো শেফালি কিছুক্ষন আগের অবসন্নতা আর ক্লান্তি ঝেড়ে।
------ তাইলে আমার সুখবরটাওতো বলতি হয় আপনেরে। হা হা হা.....
হাসির তোড়ে বাকিটুকু বলা হয় না শেফালির।
মিনুর মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। কেমন যেন একটা তৃপ্তি জাগে মনে। অসম বয়স, সম্পর্কের বৈপরীত্য , অবস্হানগত অসামঞ্জস্যতা সব কিছু ছাড়িয়ে কোথায় যেন একটা মিল ছুঁয়ে দেয় মিনুর অন্তরাত্মায়।
কেটে যায় সময়। মিনু নিজ সংসারে ফিরে আসে বিষন্নতায়। নতুন অতিথিকে হারিয়ে। গর্ভস্হ সন্তানকে মাটির গর্ভে প্রতিস্হাপন করে শুন্য কোলেই ফিরে।
জীবন চলে খুঁড়িয়ে। উৎফুল্লতাগুলো খুঁজে পায় নাআর। উচ্ছল পদচারনা নেই। জীবনকে টেনে বেড়ায় মিনু। অভ্যসবশে এসে দাঁড়ায় পূব কোনে কখনও। শেফালিকে তেমন চোখে পড়ে না আজকাল। কখনওবা একটু দেখা মিললেও ভারী শরীরটা হাঁপাতে হাঁপাতে বয়ে বেড়াতে দেখে। কথা হয় না। চোখাচোখিও না।
তারপর হঠাৎ করেই কোলাহল একদিন। গ্রীলের বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দিতেই বিস্মিত হয়ে দেখে হাসপাতাল ফেরত শেফালিকে। পিছনে ওর স্বামীর বুকের সাথে লেপ্টে থাকা তোয়ালে জড়ানো নবজাতক।
তরতর করে নেমে আসে মিনু। এক্কেবারে বড় গেইট ডিঙিয়ে সোজা ওদের উঠোনে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় শেফালির সদ্যজাত সন্তান। পিটপিটে চাউনি, তুলতুলে গাল আর রেশম কোমল নরম চুল ভর্তি মাথাটা দেখে আবেগের আতিশয্যে স্মৃতিকাতর মনটা হু হু করে ওঠে। অঝোর ধারায় মিনুর দুচোখে বর্ষা নামে, শত চেষ্টাতেও আড়াল করতে পারে না তা।
মমতার গোড়াপত্তন সেই থেকে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মিনুর তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি শুধু শেফালি কণ্যাকে দেখে।
শীতের রোদে তেলপাট করে শেফালি পরম যত্নে। রোদ গরম পানিতে গা ধুয়ে দেয়, ডাগর চোখ দুটিতে কাজল এঁকে দেয়,কপালের কোনায় দেয় মস্ত কালো টিপ। জংলি ছাপের ছোট্ট ফ্রকটা মাথা গলিয়ে পরিয়ে দিয়ে টোপা গালের ফোকলা হাসিতে টসটসে কন্যার ছিটকে পড়া আলোয় মিনুর কন্যা শোক উথলে ওঠে।
শেফালি কতকটা বুঝে হয়তো। বাচ্চার নাক টিপে দিয়ে বলে, আর এট্টু বড় হোক,ঠিক চলে যেতি চাইবে পুটি আপনের বাগানে।
----- উঁহু, পুটি নয়।অমন পুতুল পুতুল মেয়েটাকে সুন্দর নামে ডেকো।
----- কালো মেয়ের আবার নাম। সাড়া দেয়া নিয়ে কথা। তবে এ যুগের ছাওয়ালতো।" ক্যামেলিয়া" নাম ধইরে উপরের খালাম্মায় ডাক দিলে কান খাড়া কইরে এদিক ওদিক খোঁজে।
মিনুও গলা বাড়িয়ে বলে,
----- সুন্দরতো। ক্যামেলিয়াই ওর নাম।
এরপরের দৃশ্যপট পাল্টায় দ্রুত। মিনুর হাসবেন্ডের
স্কলারশীপটা হয়ে যাওয়ায় উড়াল দেয় ওরা সাত সমুদ্র পারে। প্রবাস জীবনে এক এক করে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। মিনু ফিরে আসে সন্তান সন্ততি নিয়ে আপন ঘরে লম্বা অবকাশে।
আবারো সাজে বাড়িটা। ঘর গেরস্হালিতে মনোনিবেশ করে মিনু পূর্ণ উদ্যোমে।
পূবের ব্যালকনিতে নার্সারি থেকে আনা গাছগুলি সবুজাভ ভালোবাসায় ভরে ওঠে লতায় পাতায়,ফুলে ফুলে। পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে ব্যস্ত দৃষ্টি ঘুরায় মিনু সামনের বাড়ির অপরিবর্তনীয় উঠোনটিতে। নতুন মুখের শ্রমিকদের ছুটোছুটি দেখে। কল পাড়ে ট্যপের অঝোর ধারায় বড় বড় গামলায় কাপড় ধোয়া দেখে, বাসন মাজা দেখে। কিন্তু শেফালির ভেঙ্গে পড়া স্বাস্হ্য, বিরস চেহারা সর্বোপরি এতবছর পর মিনুর সাথে একটি বারও চোখাচোখির ব্যাপারটা ঘটে না। তবে একটি নতুন দৃশ্য মনোযোগ কাড়ে মিনুর। ছাদের চিলেকোঠার এক চিলতে বারান্দায়, সানসেটের আড়ালে,নীচতলার করিডোরে অষ্টপ্রহর মুঠোফোন কানে লাগিয়ে এক অষ্টাদশীর কথোপকথন। চেহারাটা চেনা চেনা মনে হলেও ও বাড়ির কে হতে পারে অনুমান করতে পারে না মিনু দীর্ঘ অদর্শনের কারনে। পুবের ব্যালকনি থেকে মেয়েটির হাত নেড়ে কথা বলার ভংগিটা খুব মজা লাগে মিনুর। কি মিষ্টি যে লাগে দূর থেকে। বিশেষ করে গোলগাল মুখটায় নাকে দোলানো নথটা চমৎকার মানিয়েছে।
ঠিক দুদিন পরেই বিষয়টা খোলাসা হলো মিনুর কাছে। ক্যামেলিয়ার বিয়ে হয়েছে কদিন আগে। ফিরানিতে এসেছে মায়ের কাছে।
মিনু ভেবেছিলো প্রতিবেশিদের সাথে কদিনের মধ্যেই দেখা করতে যাবে হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে। কিন্তু দূর থেকে দেখা সৌন্দর্য্য গলে পড়া অষ্টাদশীই যে ক্যামেলিয়া, শুধু তাই নয় তার হারিয়ে যাওয়া কন্যার বয়সী ক্যামেলিয়া শ্বশুর বাড়ির বধূও।
পরদিনই খামে কিছু টাকা নিয়ে ছুটলো মেয়েটিকে একটু আদর ছুঁয়ে দিয়ে দোআ করে আসবে।
কিন্ত কোথায় শেফালি? ক্যামেলিয়াইবা কই?
এগিয়ে ঢুকলো একেবারে অন্দরে। রান্না বসিয়ে চুলার আগুনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শেফালি। মিনু উচ্ছ্বসিত গলায় ডাকলো,
----- শেফালি, এই শেফালি।
অবশেষে সজাগ হলো শেফালি।
আগের মত হই হই করে ওঠলো না। হাত ধরে বসালোও না। মিনু ভাবলো, হতেই পারে অনেকটা সময়ের না দেখার আড়ষ্টতা।
খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
----- ক্যামেলিয়ার বিয়ে দিলে জানি নাতো।
ওকে ডাকো, দোআটা করে যাই।
তর্জনিতে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে মাথা নীচু করে ক্ষীন কন্ঠে বললো শেফালি,
----- ভালো ছেলে পালাম, তাই ওর বাবা তাড়াহুড়ো কইরে বিয়েটা সেইরে ফেল্লো।
পুটিতো খানিক আগে চইলে গেলো ওর শ্বশুরবাড়ি।
মিনু খামটা বাড়িয়ে দিলো এবার। বললো,
-----এটা ধরো। ক্যামেলিয়াকে কিছু কিনে দিও। আবার যখন আসবে, জামাইসহ বেড়িয়ে আসতে বলো আমাদের ওখানে।
মাথা নেড়ে সায় জানালো শেফালি।
কন্যা বিদায় দেয়া কষ্টমাখা শেফালির মুখখানা দেখে আর বিরক্ত না করে মিনু চলে এলো।
সপ্তা খানেক পর এক রিলেটিভের এনগেজমেন্ট অনুষ্টান শেষে পদ্মা পাড়ের বাঁধের পথটা দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলো মিনু হাসবেন্ডের সাথে। পুরনো স্মৃতি রোমন্হনও বলা যায়।
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠ আর আঞ্চলিকতার চেনা সুরটা কানে যেতেই লক্ষ্য করলো, বটমুলের কাছে জনা কতক লোকের জটলা শেফালিকে ঘিরে।
দাঁড়িয়ে পড়লো মিনু।
শেফালি বলে চলেছে কোনদিকে খেয়াল না করেই,
----- হ্যা হ্যা পুটি ওর নাম।আমার মেয়ে। ভাবগতিক ভালো না বুইঝেতো তাড়াহুড়ো কইরে বিয়া দিলাম। কিন্তুক শয়তান মিইয়ে ( মেয়ে) যে এমনটা করবার পারে বুঝি নাই।
আপনারা কি কতি পারেন এই মহল্লার কোন বাসাটা ওদের? আমি শুধু দেইখে চইলে যাবো, কোন স্বর্গে সে আছে?
দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকলো শেফালি।
মিনু এগিয়ে গেলো। জটলার মাঝ থেকে শেফালির হাতটা ধরে টেনে নিয়ে বটমুলের বেদীতে বসালো।
বললো
----- শেফালি, কান্না থামাও। তাকাও আমার দিকে।
এবার বলোতো কি হয়েছে? মেয়ের শ্বশুরবাড়ি না দেখেই বিয়ে দিয়েছো?
শেফালি মিনুর দু হাত ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তা হলো, পুটি মানে ক্যামেলিয়া কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মেনে নেয়া সম্ভব নয় বলে চটজলদি ক্যামেলিয়ার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিপদ কেটে গেছে মনে করে নিশ্চিন্ত হয়।
কদিন যেতে না যেতে খবর আসে ক্যামেলিয়া তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথেই আইনানুযায়ী পাকাপোক্ত সংসার পেতেছে।
মিনু সব শুনে বললো,
----- প্রথমে যখন সামাল দিতে পারো নি, জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে না দিয়ে ওর পছন্দটাকেই মেনে নিলে না কেন?
এবার কান্না থামিয়ে মাথাটা নীচু করে কিছুক্ষন চুপ থাকলো শেফালি। তারপর ধীরে ধীরে যা বললো তার সারমর্ম হলো, ক্যামেলিয়ার প্রেমটা একই ধর্মাবলম্বীর নয়। দুই ধর্মের দুজন হওয়ায় দুপক্ষের অভিভাবকেরাই বাঁধ সেধেছেন সঙ্গতভাবেই।
নিরুপায় হয়ে ক্যামেলিয়াকে শক্ত বাঁধন দিতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে গিয়েছে পুরোই।
মিনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেফালির হাতটা ধরে বললো, যে নিজেই হারিয়ে গেছে তাকে এভাবে পথে পথে খুঁজে বেড়ানোর কোন মানে নেই। চলো বাসায় চলো আমার সাথে।
আস্তে করে হাতটি সরিয়ে নিলো শেফালি।
------ আপনি চইলে যান। পুটির কারনে এতকালের আশ্রয় থেইকে আমাদের বাহির হতি হয়েছে। মালিকের বাড়িতে কোন অধর্ম মেইনে নিতে নারাজ তারা।
তাইতো তারে দেখতি বেরোইছি। দুধেভাতে বড় কইরে, লেখাপড়া শিখায়ে, নিজেরা খেয়ে না খেয়ে দামী মোবাইলটা, পোশাকটা, ঘড়িটা কিইনে দিয়েছি তার সমাজ রক্ষা করার এই শাস্তি সে কোন জ্ঞানে দিতি পারলো?
পাড়ার বৌ ঝিরা একে একে ওকে ঘিরে ধরেছে ততক্ষনে। অদূরে দাঁড়ানো হাসবেন্ডকে লক্ষ্য করে মিনু পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলো, ভুলটা যে তোমাদেরই শেফালি। ওর অবস্হানটা ওকে বুঝতে দাওনি বলে ও তোমাদের একজন হতে পারে নি। লেখাপড়া শিখিয়েছো, শিক্ষা দিতে পারো নি। দামী জীবনে অভ্যস্ত করিয়েছো, কিভাবে যোগাড় করতে হয়, জানাও নি।
বাস্তবতা থেকে এত দূরে ঠেলে দিয়েছো বলেই ও স্বর্গটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে চেয়েছে।
হয়তো সেদিনও বেশি দূরে নয়। বাস্তবতার ঘা খেয়ে সেও পথে পথে আশ্রয়হীন বাবামাকে খুঁজে ফিরবে জনে জনে।
মন্তব্য করুন: