শনিবার, ২৩শে নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া
  • নাসির উদ্দীনকে সিইসি করে নির্বাচন কমিশন গঠন
  • আমরা এক পরিবার, কেউ কারো শত্রু হবো না
  • শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা
  • আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উদ্যোক্তা নয় চাকরিপ্রার্থী তৈরি করে
  • নির্বাচনকালে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা চায় ইসি
  • রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কার না চায় তাহলে এখনই নির্বাচন দেওয়া হবে
  • বুধবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে ইসি অনুসন্ধান কমিটি
  • ঢাকার যে ৫ স্থানে আজ সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ
  • রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ

ছোটগল্প

আপেল প্লেট

রোকেয়া সুলতানা

প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৯

আমার ডাকনাম আপেল প্লেট, কারণ আমার বুকের ঠিক মাঝখানে দুটো সবুজ পাতা সহ লাল টকটকে খুব সুন্দর একটা আপেলের ছবি আঁকা আছে। আলো ঝলমলে দোকানের এক কোনায় তাকের উপর আমি বসে আছি দীর্ঘদিন ধরে। রোজই দোকানে কতো রং-বেরঙের মানুষ আসে।

কতো ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আসে তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে অথবা কোলে চড়ে। কেউ কেউ মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে দোকানের বাতাস ভরিয়ে দেয়, আবার কেউ কেউ এমন কান্নাকাটি শুরু করে যে মনে হয় ওরা দোকান থেকে গেলেই বাঁচি।

মাঝে মাঝে আসে কিশোরী মেয়েরা, স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তারা একটু ঢু মারে আমাদের এই দোকানে। দু'দিন পর বন্ধুর জন্মদিন, বন্ধুর জন্য কার্টুন আঁকা পানির মগ অথবা ঐ রকম অন্য কিছু নিতে।

এ দোকানের কার্টুন আঁকা মগগুলো খুব সুন্দর। প্রায় প্রতিদিনই ৭/৮ টা মগ বিক্রি হয়। বেশিরভাগই বিক্রি হয় ছোট ছোট ছেলে -মেয়েদের কাছে। বছরের প্রথম ও শেষদিকে মানে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে এসব জিনিস প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয় । আমি হতাশ চোখে মগগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, ইশ্ ! ওদের কি ভাগ্য ভালো! অথচ আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
নিজেকে প্রশ্ন করি, 'আমি কি এতোই কুৎসিত?' মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমার পাশের বন্ধু পানির জগের কাছে মনের কষ্টটা খুলে বলি। পানির জগটা খুব ভালো। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, 'একটুও মন খারাপ কোরো না, দেখো আমাকে ছেড়ে একদিন ঠিকই তুমি চলে যাবে।' এমনি যখন আমার মনের অবস্থা ঠিক তখনই এক মা এলেন, সাথে ফুটফুটে তিনটি বাচ্চা। দোকানে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র দেখতে দেখতে তারা আমার সামনে এসে দাড়িয়ে গেলেন। বড় মেয়েটা তার মাকে দেখিয়ে বললো, 'আম্মু, দেখ আপেল প্লেটটা কী সুন্দর! আমাকে এটা কিনে দিতে হবে।'

মেয়েটির মায়ের মুখটাও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমাকে দেখে । উনি বললেন,'সত্যিই তো! আপেল প্লেটটা দেখে আমারো তো খুব লোভ লাগছে। তবে আজ তো এটা আমরা কিনতে পারবো না। আরেকদিন এসে এটা আমরা নিয়ে যাবো।এই তোমাকে প্রমিস করছি।'
এ কথা বলে উনি বাচ্চাদের জন্য তিনটা কার্টুন আঁকা মগ ও তিনটা কমলা রঙের স্যুপের বাটি-চামচ কিনে নিয়ে চলে গেলেন, তবে যাওয়ার আগে দোকানের মালিককে বলে গেলেন, 'এই আপেল প্লেটটা একটু আলাদা করে রাখবেন, আমি দু-এক দিনের মধ্যে এসে নিয়ে যাবো।' আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলো কিন্তু সেই মায়ের আর দেখা নেই। আমি মনে খুব কষ্ট পেলাম। পাশের পানির জগ কে বললাম, 'দেখলে তো, আমায় কেউ পছন্দ করে না। কেউ আমাকে নিতে চায় না!'

একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ শিশু কন্ঠের কলকাকলিতে আমার দিবানিদ্রা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি সেদিনের সেই মা তার বাচ্চাদের নিয়ে দোকানে এসে মালিকের সাথে কথা বলছেন। আমার ব্যাপারেই কথা বলতে শুনলাম। আমার বন্ধু পানির জগ মন খারাপ করে বললো, 'এবার তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ বন্ধু!' জগের জন্য আমারও মন কেমন করতে লাগলো।

আমাকে সুন্দর একটা প্যাকেটে ভরে মায়ের হাতে দেয়া হলো। বড় মেয়েটা মায়ের হাত থেকে প্যাকেটটা নিজের হাতে নিয়ে বললো, 'এটা আমার।' ছোট ভাই-বোন দুটো তার হাতের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

মনে আছে পুরো পৃথিবীতে সেদিনটা ছিল একটা স্মরনীয় দিন । বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিন। সন্ধ্যার সাথে সাথেই চারিদিকে বাজি ফুটতে শুরু হয়ে গেছে । আকাশে আতশবাজির ঝলকানি। বাচ্চারা মায়ের কাছে আব্দার শুরু করে দিল ছাদে গিয়ে তারা আতশবাজি দেখতে চায়। বাচ্চাদের সাথে আমাকেও নিয়ে মা ছাদে গেলেন। আমাকে নেওয়ার কারণ চকলেট গুলো কিসে করে নেবেন ভাবতে গিয়ে মায়ের আমার কথাই মনে পড়লো। ছোট ছোট ছেলে -মেয়েরা আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার কাছ থেকে চকলেট নিয়ে খাচ্ছে এতেই আমি মহা খুশি।

নানা রঙের আতশবাজির আলোয় আকাশটা রঙিন করে দিয়ে নতুন শতাব্দীকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। খুব জোরে জোরে দুমদাম বাজি ফুটানোর শব্দে ভয় পেয়ে ছোট ছেলেটা মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলছে,'আম্মু দুম ভয়।' মা ছেলেকে অভয় দিয়ে বলছেন,'কিসের ভয় বাবা? আমি আছি না? আমি থাকলে কোনো ভয়ই তোমার কাছে আসতে পারবে না।' তবুও ছেলেটি বাজির শব্দে ভয় পেয়ে বারবার মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে থাকে।বাধ্য হয়ে মা বাচ্চাদের নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসেন।

দীর্ঘ দিন হয়ে গেল আমি এই বাড়িতে মা আর বাচ্চাদের সাথে বসবাস করছি। বাচ্চাদের মাকে আমি মা বলে ডাকি, আর বাচ্চাদের আদর করে বলি বন্ধু। কিন্তু তারা আমার কথা শুনতে পায় না। এখন এটাই আমার নিজের বাড়ি, আমার শান্তির জায়গা।

সেই বড় মেয়েটি যে আমাকে পছন্দ করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। এইতো কিছুদিন আগে সে তার শ্বশুরবাড়ি আলোকিত করতে আমাদের ছেড়ে চলে গেল।

আর সেই 'দুম ভয়' পাওয়া ছেলেটা যে বাজির শব্দে ভয় পেয়ে মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতো সে এখন মাকে ফেলে পড়াশোনা করতে চলে গেছে অনেক দূরের এক দেশে। সেই ছোট্ট মেয়েটা যে মায়ের কোলে কোলে থাকতো সেও এখন অনেক বড়। সেও পড়াশোনার জন্য গেছে দেশের বাইরে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে এক শীতের দেশে। শীতকাতুরে মেয়েটা শীতের দেশে কিভাবে থাকবে এই চিন্তায় মা সব সময় অস্থির থাকেন।

অনেক যত্ন আর ভালোবাসা পেয়েছি আমি এখানে এই বাড়িতে এসে। আমার বয়স বাড়ছে, চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানি একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে। তখন বড়ো মেয়েটির মতো আমারও খুব কষ্ট হবে এদের ছেড়ে থাকতে। ভাবতে গেলে আমার খুব কান্না পায়। সেই 'দুম ভয়' পাওয়া ছেলেটা আর শীতকাতুরে ছোট্ট মেয়েটার মতো আমিও মাকে খুব মিস করবো।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর