প্রকাশিত:
২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:২০
প্রথম গবেষণার ফলাফল প্রকাশের উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটনে যাওয়ার গল্পটা আজকে লিখছি। আমি মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পরে প্রথম চাকরি হিসাবে ব্র্যাকে একটা রিসার্চ প্রজেক্টে জয়েন করি। সেসময় যদিও বাংলাদেশে মাতৃত্ব জনিত মৃত্যুর উপর বেশ কিছু গবেষণা ছিল কিন্তু মায়েদের অসুস্থতার (maternal morbidity) উপরে সেটাই ছিল এদেশে প্রথম গবেষণা। গবেষণাটি ব্র্যাক এবং লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন যৌথভাবে করেছিল।
সময়টা ১৯৯৩। গবেষণাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে রিসার্চ জগতে বেশ সাড়া পড়ে গেল, ওয়াশিংটন থেকে কনফারেন্সে ফলাফল প্রেজেন্ট করার জন্য ডাক আসলো। আমেরিকায় আমার এই প্রথম যাত্রা, কেন জানিনা একা ফ্লাইটে সময়টা বড় দীর্ঘ মনে হলো। ভাগ্যিস আমার কর্তা প্লেনে ওঠার আগে এয়ারপোর্ট থেকে আমার প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহের একটা মোটাসোটা উপন্যাস হাতে দিয়েছিল, সারা রাস্তা সেটা পড়তে পড়তে গেলাম। হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে সফর সঙ্গী হিসেবে এক আমেরিকান মহিলাকে পেলাম। উনি জানতে চাইলেন আমার ন্যাশনাল ড্রেস কি? দেখলাম সে শাড়ি চেনে না। গল্প করতে গিয়ে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে উনি একজন শিক্ষিত মহিলা কিন্তু পৃথিবীতে কোথায় কি ঘটছে সে সম্পর্কে এতোটুকু উৎসাহিত নন বা ওয়াকিবহাল নন, তাই আলাপ বেশি দূর আগালো না।
পরে আব্বার সাথে এই ব্যাপারটা শেয়ার করাতে আব্বা বলেছিল “দেখো, ওদের কিবা এসে যায় এটা জেনে যে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটে যাচ্ছে, মুরগির ছানাদেরকে যেমন খাঁচা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় অনেকটা সেভাবেই তারা তথ্যবঞ্চিত”। অন্যদিকে আমাদের মত দেশের মানুষ এসব ব্যাপারে প্রবল আগ্রহী কারণ আমাদের নড়বড়ে ইকোনমি অনেক কিছুর সাথে জড়িত কিংবা নির্ভরশীল” । যাইহোক, আমি যেহেতু ট্রাভেল এওয়ার্ড পেয়েছিলাম, পাঁচ তারা Grand Hyatt hotel এ ঠাঁই পেলাম। পাঁচ তারা হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা ও প্রথম, রুমে ঢুকতে গেলে কার্ড পাঞ্চ করতে হয় সেটুকু পর্যন্ত জানতাম না, ভুলে গেলে চলবে না সময়টা কিন্তু ১৯৯৩। দরজার পাশে কার্ডটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখার সাথে সাথে আমাকে চমকে দিয়ে প্রয়োজনীয় আলো জ্বলে উঠল, যে স্পেসে পা রাখি শুধু সেখানকার আলো জ্বলে।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, কলের নিচে হাত দিলেই যে পানি পড়ে এটা আমি শিখলাম, প্লেনের মতো অটো শাওয়ার এবং ফ্লাশ। আলিশান রুমের সাথে লিভিং, ড্রেসিং এবং কিচেন স্পেস। ফ্রিজ ভর্তি খাবার, ফলমুল, চা-কফির কিছু কমতি নেই। হোটেলের উপরের রুম থেকে দেখলে একটা টলটলা নীল জলের পুল দেখা যায়। পুলসাইড ক্যাফেতে মানুষে গল্প করছে, খাচ্ছে। পেল্লাই সাইজের এক পিয়ানোতে অনবদ্য সুর বাজিয়ে যাচ্ছে পিয়ানোবাদক। ভাবলাম গবেষণাটা করে তো আমরা নিশ্চয়ই বিশাল কিছু করে ফেলেছি না হলে এত খাতির করছে! আমার প্রেজেন্টেশন শেষ পর্যন্ত যদিও খুব প্রশংসিত হলো কিন্তু প্রথমেই একটা বিপত্তি ঘটেছিল। তখনকার দিনে OHP শিট এর উপরে টাইপ করে সেটা ওভারহেড প্রজেক্টরে দেখানো হতো কিংবা বড়জোর স্লাইড প্রজেক্টর ব্যবহার করা হতো, কম্পিউটারের বালাই ছিল না।
আমি অফিস থেকে সুন্দর করে প্রজেক্টরের স্লাইড বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম কিন্তু আমার এক কলিগ সাবধান করে বলেছিল "অনেক সময় অটোমেটিক স্লাইড প্রজেক্টর গন্ডগোল করে, ব্যাকআপ হিসেবে OHP শিট নিয়ে যাও"। সত্যি সত্যি তাই ঘটলো, প্রেজেন্টেশনে প্রথম দুইটা স্লাইড দেখানোর পরে জ্যাম হয়ে গেল প্রজেক্টর, অর্থাৎ পরের স্লাইড গুলো আর আসে না। আল্লাহ মহান, তাড়াতাড়ি টাইপ করা শীট ওভারহেড প্রজেক্টরে ব্যবহার করে প্রেজেন্টেশন সারলাম। কনফারেন্স শেষে বেড়ানোর পালা। অবাক হয়ে গেলাম সেখানে সব ধরনের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতে পর্যটকদের এতটুকু বাধা নেই, হোয়াইট হাউসেও সহজে ঢোকা গেল। ফাউন্ডার লিডার আব্রাহাম লিংকনের বিশাল ভাস্কর্য দেখলাম, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট দেখলাম যা ৫৫৫ ফিট উঁচু এবং তাদের জাতীয় পতাকা দিয়ে ঘেরা, যার প্রতিচ্ছায়া সামনের লেকে দেখা যায়।
দেখলাম ন্যাশনাল ক্যাপিটাল কলাম, বিশ একর জায়গা জুড়ে যার ২২টি অংশ সারিবদ্ধ ভাবে রয়েছে। আরো দেখলাম air and space মিউজিয়াম যেখানে স্পেসশিপ এবং স্পেসস্টেশনের পুরনো অংশ দিয়ে মিউজিয়ামটা করা হয়েছে, পুরনো রকেটে ও আছে। একটাই অসুবিধা হচ্ছিল সেটা হচ্ছে ভেতো বাঙালির ভাতের অভাব। নিউইয়র্ক এ আমার চাচা থাকতেন, চাচি ফোন করে বললেন “মা তুমি নিউইয়র্কে আসলে আমি তোমাকে মন ভরে ডাল ভাত খাওয়াবো, কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করো”। সাতদিন পরে নিউইয়র্কে চাচার বাসায় গিয়ে ভাত খেলাম পেট ভরে। চাচি খুব ভালো গোলাপজামুন মিষ্টি বানালেন, লক্ষ্য করলাম আমার যে চাচি দেশে থাকতে কুটোটি নাড়তেন না, তিনি বিদেশে এসে ডাকসাইটে রাধুনী হয়েছেন এবং চমৎকার বিরিয়ানি করে খাওয়ালেন। ওখানে বাঙ্গালীদের মধ্যে রেসিপি চালাচালি হয়, মনে হলো সাইলেন্ট কম্পিটিশনও হয়। চাচি আমাকে ফেরিতে করে লিবার্টি দ্বীপে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখাতে নিয়ে গেলেন যা ৯২ মিটার উঁচু, কিন্তু টিকেটের লম্বা লাইনের কারণে উপরে ওঠা হলো না। অনেকেই জানেন যে এই স্ট্যাচুটি তামার তৈরি, অক্সিডাইজড হয়ে গ্রিন হয়ে গেছে এবং ফ্রান্স থেকে উপহার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে (সম্ভবত নদীপথে) এসেছে। অবশ্য স্ট্যাচুটির ডান হাতে যে মশালটা আছে সেখানে ওঠা বহু আগে থেকেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। চাচি আমাকে আন্ডারগ্রাউন্ড একুরিয়াম দেখাতে নিয়ে গেলেন সেখানে আবার ওপেন গ্যালারিতে সিল মাছের একটা অপূর্ব শো হয়। নিউইয়র্ক থেকে দু দিনের জন্য বোস্টনে গেলাম হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি দেখার জন্য, ওখানে আমাদের এক সিনিয়র আপা পিএইচডি করছিলেন। তার কাছে রাত্রে থাকলাম।
ঐদিন প্রচন্ড বরফ পড়ছিল, গাড়িগুলো সব ঢেকে গেল বরফে, স্কুল বন্ধ। পরেরদিন বোস্টনের বিখ্যাত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম দেখলাম। রঙিন কাঁচ দিয়ে যে এত নিখুঁত ভাবে ফুলফল, পাতা ও পোকামাকড় বানানো যায়, তা না দেখলে কল্পনার অতীত। আর্ট গ্যালারি থেকে ভ্যানগগের আঁকা একটা পোস্টার চিত্র কিনে নিয়ে আসলাম। নিউইয়র্কে ফিরে নতুন করে সুটকেস কিনতে হল কারণ চাচা চাচি বাসার সবার জন্য একগাদা উপহার দিলেন। তখোনো টুইন টাওয়ারের অস্তিত্ব ছিল, পরবর্তী সময় নিউইয়র্কে গিয়ে আর টুইন টাওয়ার দেখতে পাইনি, ওই স্থানটাকে পরবর্তীতে জিরো পয়েন্ট বলা হতো আর ওখানে গেলে যারা অঘটনে মারা গেছেন তাদের জন্য মনটা সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত।
মন্তব্য করুন: