প্রকাশিত:
৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৫৯
খুব ছোট বেলা থেকে আমি খুব উদাসি প্রকৃতির।একা একা ঘোরাঘুরি করাটা আমার অভ্যাস।তবে আমার ঘোরার জায়গা গুলো বাকিদের মতো পাহাড়,,,নদী,,, ঝর্ণা কিংবা সমুদ্র না।আমি বেশিরভাগ সময় ঘুরি হাসপাতালে কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে।হয়তো শুনতে অদ্ভুত মনে হবে তবে এটাই সত্যি।এই জন্যই হয়তো আমার ঘুরার কোনো সাথী নেই।
আজ ১০ ডিসেম্বর ২০২১ আমি সকাল ১১টায় বাসা থেকে বের হয়েছি।আমার কাছে মনে হয় সকাল ১১টা ঘুরাঘুরি জন্য উত্তম সময় এই সময় টাকে ঠিক সকাল ও বলা যায় না আবার ঠিক দুপুর ও বলা যায় না। বাইরে চমৎকার রৌদ্র উঠেছে,,এই শীত কালে সকাল ১১টার রৌদ্র টা খুব একটা বেশি গায়ে লাগে না তার উপর বাইরে খুব ঠান্ডা হাওয়া সব মিলিয়ে আমার কাছে দিন টা চমৎকার।
আমি রওনা হলাম গন্তব্যে কোনো একটা সরকারি হাসপাতালে। কারণ এখন প্রাইভেট হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করাটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার।কারণ ওইখানে খুব কড়া নিরাপত্তা দেওয়া হয়।আর হাসপাতালে রিসেপশনে আমাকে প্রশ্ন করা হবে কত তলায় রুগী দেখতে যাবেন??রুগীর রুম নাম্বার কত??হাজারো প্রশ্ন। তবে সরকারি হাসপাতালে এতো ঝামেলা নেই।ওইখানে কেউ আপনাকে অতো প্রশ্ন করবে না।যদিও কেউ প্রশ্ন করে তাহলে গুছিয়ে কয়েকটা মিথ্যা বলে দিলেই আপনি বেঁচে যাবেন। সে যাই হোক আমি পৌঁছে গেলাম এই শহরের নাম করা সরকারি হাসপাতালে।
হাসপাতালে ঘুরাঘুরি আমার কেনো পছন্দ যানেন?কারণ হাসপাতালে প্রতিটা রুমে একটা করে Story বহন করে।কারো Story সুখের কারোটা আবার খুব দুঃখের। যার Story যেমনি হোক না কেনো প্রতিটা Story আপনাকে কিছু না কিছু শিখাবে।
প্রথমে আমি হাসপাতালে ডুকে চলে গেলাম ২য় তলায় ওখানে একটা অফারেশন থিয়েটার আছে।এখানে সিজার নামে ভয়ংকর জিনিসটা করা হয়।আমি ২য় তলায় কোনায় গিয়ে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। আমি দেখলাম ওই রুমটার সামনে অনেক ভীড়ে বুঝতে পারলাম ওইখানে হয়তো কোনো মাকে ঢুকানো হয়েছে। একটু পরেই পৃথিবীর তে আসতে চলেছে কোনো এক নতুন অতিথি। একজন মাঝ বয়সি ভদ্র মহিলা কান্না করছে এবং তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আরেক জন মাঝ বয়সি ভদ্র মহিলা। আমি বুঝতে পারলাম যে ভদ্র মহিলা কান্না করছে তিনি যে মেয়েটি সিজার রুমে রয়েছে তার মা।কারণ "মায়েদের চোখের পানি সবার থেকে আলাদা হয়"। আর যে ভদ্র মহিলা সান্ত্বনা দিচ্ছে তিনি মেয়েটির শাশুড়ি মা।এটা আমার ধারণা দেখা যাক এটা কতটা সত্যি হয়।অফারেশন রুমের দরজার সামনে একজন সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে তার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। তার চোখে পানি টলমল করছে কিন্তুু সে কান্না করছে পারছে না "কারণ ছেলে দের কান্না করতে নেই" ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে এটি তার জন্য পৃথিবীর সব থেকে কঠিন সময়।আমি বুঝতে পারলাম এটি যে মেয়েটির সিজার হচ্ছে তার স্বামী। ছেলেটির মাঝে খুব অস্থিরতা কাজ করছে সে একটু পর পর ঘড়ি দেখছে। কারণ "অপেক্ষা খুব কঠিন সময় "।
ঠিক ২০মিনিট পর সিজার রুম থেকে একটা কান্নার শব্দ শুনা গেলো।সবার চোখে মুখে যেমন যেন একটা আতংক দেখা গেলো।সিজার রুম থেকে একটা নার্স বের হয়ে বললো আপনাদের রুগী একটা কন্যা সন্তান এর জন্ম দিয়েছে। ছেলেটা বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ আমার Wife কেমন আছে?নার্স বললো জ্বি উনিও ভালো আছে। এই বলে নার্স আবার ভেতরে চলে গেছে।সবার মুখে এবার মুগ্ধ করা হাসি।মাঝ বয়সী ভদ্র মহিলাটি সবাইকে কল দিয়ে বলছে আমি দাদি হয়েছি।আমার ছেলের মেয়ে হয়েছে।যাক তাহলে আমার ধারণা ঠিক ছিলো।পাঁচ মিনিট পর নার্স একটা সাদা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বাচ্চা টিকে এনে তার বাবা কাছে দিলো।বাবা তার মেয়েকে কোলে নিয়ে খুব আদর করলো।আমি দূর থেকে বাচ্চা টিকে দেখলাম,, আর মনে মনে বললাম এই পৃথিবীতে তোমাকে স্বাগতম।মনে মনে এই বাচ্চা মেয়েটির একটা নাম ও ঠিক করলাম "চারুতলা"।যাই হোক এবার আমায় যেতে হবে।ভালো থেকো চারুতলা।
এবার আমি গেলাম ৩য় তলায় এখানে আছে ICU। যে রুগীদের অবস্থা খুব বেশি খারাপ থাকে তাদের এই খানে রাখা হয়।৩য় তলায় খুব শান্ত এখানে খুব বেশি মানুষের ভির নেই।হাতে গনা ৩-৪জন লোক বসে আছে।যারা বসে আছে তারা প্রতেকে খুব চিন্তিত।একটু পর পর নার্স সেখানে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। যারা বসে আছে তারা অনেকে নার্স এর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তুু নার্সদের ওতো সময় নেই কথা বলার।হঠাৎ করে একজন নার্স সেখান থেকে বের হয়ে ডাক্তার কে ডাকতে গেলো তাকে খুব আতংকিত দেখাচ্ছে,,,মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু একটা ঘটেছে।সাথে সাথে ডাক্তার এলো। যে ৩-৪ জন লোক বসে ছিলো তারা উঠে দাঁড়ালো।তাদের মাঝে অজানা ভয় দেখা যাচ্ছে। এবং আমি নিজেও একটা অজানা ভয় অনুভব করছি। ৬-৭মিনিট পর ডাক্তার বের হলো এবং তাদের বললো I sorry আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তুু ওনার হার্ড়বিট বাড়াতে পারিনি।সাথে সাথে এই শান্ত পরিবেশ টা কেমন যানি ভয়ংকর পরিবেশে রূপ নিলো।২০-২১বছর বসয়ের একটা তরুণ ছেলে মা মা করে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো।আমি বুঝতে পারলাম ICU তে কোনো এক ভদ্রমহিলা ছিলো।পৃথিবীর সব থেকে কাছের মানুষ টাকে ছেলে টা হারিয়েছে।তার কষ্টটা হয়তো আমরা কেউই অনুভব করতে পারবো না।আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম এই মাকে আপনি জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
এর পর আমি গেলাম ৪র্থ তলায়। ওই খানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।এই ধরুন হার্ট এর বিভিন্ন পরীক্ষা,,,আল্ট্রাসাউন্ড,,,রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি। এই খানে ১৫বছর বয়সী একটা মেয়ের সাথে আমার দেখা সে তার বাবা আর ভাই এর সাথে এখানে এসেছে।রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করছে মেয়েটার একা একটা সিটে বসে আছে আমি মেয়ে টার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। আমি মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম কী পরীক্ষা করাতে এসেছো??মেয়েটা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমি ঠিক যানি না আমার বাবা আর ভাই যানে।আমি বললাম ওহ আচ্ছা।আমি আবার প্রশ্ন করলাম কী নাম তোমার কিসে পড়ো তুমি?ও বললো আমার নাম জুই আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। আমি বললাম বাহ সামনে তো SSC দিবে পড়াশোনা কেমন চলছে।মেয়েটি বললো আমি হয়তো পরিক্ষা দিবো না।আমি অবাক হয়ে বললাম ওমা সে কী কথা পরীক্ষা কেনো দিবে না?মেয়েটি হতাশ গলায় বললো আমি অনিশ্চিত জীবনে আছি।আমি বললাম ঠিক বুঝলাম না। সে বললো আমার শরীরে ভয়ংকর ক্যানসার বাসা বেঁধেছে।ডাক্তার বলেছে আমি বেশি দিন বাঁচবো না।আমি মেয়েদিন দিকে তাকিয়ে সাত্বনা দেওয়া সুরে বললাম আরে বোকা কিছুই হবে।আল্লাহ ভরসা সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখবে তুমি খুব তারাতারি সুস্থ হয়ে যাবে।মেয়েটা আমাকে বললো আচ্ছা আপ্পি সৃষ্টিকর্তা এতো কঠিন করে মানুষ এর নিয়তি লিখে কেনো?জুই এর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই।এর মাঝে ওর বাবা আর ভাই রিপোর্ট নিয়ে চলে আসে।জুই চলে যায়,,আমি ওর চলে যাওয়া দেখি আর ওর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকি।আমি যানি এই প্রশ্নের উত্তর আমি হয়তো কখনো পাবো না।আমি মনে মনে ভাবতে থাকি জুই এর সাথে কি আমার আর কখনো দেখা হবে না?এটাই কি শেষ দেখা?
আজকের মতো আমার ঘুরা এখানে সমাপ্ত আমি ৪র্থ তলা থেকে নামতে থাকতাম।৩য় তলায় সিড়িতে এসে দুজন মানুষ এর সাথে দেখা। তাদের বয়স প্রায় ৬০ থেকে বেশি। তারা স্বামী স্ত্রী। স্বামী এতোদিন অসুস্থ ছিলো আজকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে।তাদের চোখে -মুখে আনন্দের শেষ নেই।
নীচ তলায় এসে আবার দেখলাম একজন বাবার আর্তনাদ কারণ তার ২৫ বছর এর ছেলে বাইক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। একটু আগে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করে।
আমি চুপচাপ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলাম।আমার চারপাশ টা কেমন যানি অন্য রকম মনে হতে লাগলো।মানুষ এর নিয়তি আসলে খুব কঠিন।একি সময় একি তারিখে একি স্থানে এক এক কাহিনী। সত্যি অভাগ লাগে তাই না!
মন্তব্য করুন: