প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:৩২
তিন বছর পর। বদলে গেছে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, এ পেশায় আসার জন্য মেধাবীদের মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগীতা। বাংলাদেশের মা-বাবারা এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের ছেলেমেয়েরা যেনো ভবিষ্যতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। বিদ্যালয়গুলোতে এখন ছাত্র সংখ্যা সন্তোষজনক। বিদ্যালয়ের সময় দশটা থেকে তিনটা পর্যন্ত হওয়াতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই থাকেন প্রাণচঞ্চল। প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ায় রাতারাতি বদলে গেছে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান। পর্যাপ্ত বেতন পাওয়ায় শিক্ষকদের আর প্রাইভেট কোচিং-এ সময় দিতে হচ্ছে না। তারা তাদের সম্পূর্ন সময় ব্যয় করছেন শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কাজে। এমন একটা সময়ের জন্য এতদিন শুধু স্বপ্নই দেখে আসছিলেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা।
রাবাড়ী মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আজ নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা আগেই বিদ্যালয়ে এসেছেন। কারণ আজ তাদের বিদ্যালয়ে আসবেন শিক্ষা উপ-সচিব জনাব শাকিল আহ্মেদ। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব সাইফুল ইসলাম অফিস রুমে বসে তার সহকর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন কি কি করতে হবে। এ বছর তাদের বিদ্যালয়টি বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা প্রায় এগারোশত। শিক্ষক আছেন ত্রিশ জন। অথচ তিন বছর আগেও এখানে মাত্র পনের জন শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যালয়ে আগে কক্ষ সংখ্যা ছিলো বারোটি। বর্তমানে পঁচিশটি কক্ষ রয়েছে। বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন এক শিফটে চলে। সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে বেলা তিনটা পর্যন্ত চলে।
এরমধ্যে একটা পঁচিশ মিনিট থেকে দুইটা পর্যস্ত যোহরের নামাজ ও দুপুরের খাবারের জন্য বিরতি। আবার দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক এবং দশটা থেকে একটা পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাশ চলে। এছাড়াও দশটা থেকে দশটা বিশ মিনিট পর্যন্ত সমাবেশ এবং দশটা পঁচিশ মিনিট থেকে একসাথে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চশ শ্রেণির ক্লাশ শুরু হয়। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির দুপুরের আগে চারটি ক্লাশ, আর বিরতির পর দুইটি ক্লাশ। এভাবে শনি থেকে বুধ একই নিয়মে চলে। বৃহস্পতিবার দশটা থেকে শুরু হয়ে একটা পঁচিশ মিনিট-এ ছুটি হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক বেড়ে গেছে। প্রধান শিক্ষক সাইফুল স্যার বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ সবাইকে নিয়ে ঘুরে দেখলেন। সব কিছু ঠিক আছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরাও শতভাগ ইউনিফর্ম পরে এসেছে। সবাইকে বেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন লাগছে। সাইফুল স্যার তার সব সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন।
প্রায় দুই ঘন্টা পর শিক্ষা উপ-সচিব শাকিল আহ্মেদ, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয়গণ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন। বিদ্যালয়ের কাবদল তাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিল। শাকিল আহ্মেদ তার প্রাণপ্রিয় শিক্ষক সাইফুল স্যারকে দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর পর দেখে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারেন নি। স্যার’, বলে জড়িয়ে ধরলেন তিনি সাইফুল স্যারকে। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে এ দৃশ্য দেখছে।
সময় যেন থমকে গেছে তখন। মনে হচ্ছে যেনো কোনো সন্তান তার হারানো পিতাকে দীর্ঘদিন পর খুঁজে পেয়েছে। সাইফুল স্যার অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে সামলে নিয়ে বললেন, ছি ছি স্যার, আপনাদের দাঁড় করিয়ে রাখলাম। আসুন, আসুন ভিতরে আসুন। শাকিল বাধা দিয়ে বলল, “স্যার, আমাকে এভাবে বলবেন না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, আপনাদের মতো শিক্ষাগুরুর সামনে। সত্যি বলতে কী আজ আমি এখানে কোনো ভিজিটর হিসেবে আসিনি। আমি এসেছি শুধু আপনাদের দেখতে”। এ কথা বলতে বলতে শাকিল
আহ্মেদ ও অন্যান্যরা বিশাল ও সুসজ্জিত অফিস কক্ষে প্রবেশ করলেন। প্রধান শিক্ষক কিছুতেই শিক্ষা উপসচিবকে তার নিজের চেয়ারে বসাতে পারেন নি। শাকিল আহ্মেদ-এর বিনয় দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। সেই সাথে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ দেখেও সবাই সন্তুষ্ট হলো। শাকিল আহ্মেদ উপস্থিত সকল শিক্ষকের সাথে পরিচিত হলেন এবং তাদের পারিবারিক অবস্থারও খোঁজ-খবর নিলেন।
শিক্ষকেরা সবাই শাকিল আহ্মেদকে তাদের বর্তমান অবস্থানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানালেন। হালকা চা-নাস্তা পর্ব সেরে প্রধান শিক্ষকের বিশেষ অনুরোধে সবাই শ্রেণিকক্ষগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলেন। শাকিল আহ্মেদ ও অন্যান্যরা শিক্ষার্থীদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছণœতা ও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি দেখে সবাই প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষকদের আন্তরিক প্রশংসা করলেন। বিদায় নেয়ার আগে শাকিল আহ্মেদ সব শিক্ষককে তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন এবং যে কোন সমস্যায় তার সাথে নিৎসংকোচে যোগাযোগ করতে বললেন।
এভাবে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চললো বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূয়সী প্রসংশা পেলো বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখাতে লাগলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা উপ-সচিব শাকিল আহ্মেদকে এমন যুগান্তকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখায় বিশেষ পুরুষ্কারে ভূষিত করলেন এবং শীঘ্রই তার পদোন্নতির ঘোষনা দিলেন। এভাবে পূরণ হলো প্রাথমিক শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন।
প্রিয় পাঠক, হয়তো অনেকে আমাকে পাগল ভাবছেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়, বলুন? কবি আহসান হাবীবের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে-
আশা সেতো মরিচীকা, আমরা বলি, ওরা বলে, আশাই জীবন; জীবনের শ্রী”।
হ্যাঁ, আমি স্বপ্ন দেখি। একদিন অবশ্যই সেইদিন আসবে। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হবো বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানিত পেশাজীবি। হয়তো শাকিল আহ্মেদের মতোই আমাদের কোন প্রাণপ্রিয় বোধোদয় হবে আমাদের ব্যাপারে। সে আশায় বসে আছি আজও। সেই দিন, সেই স্বপ্নেরও দিন আসবে, আসবেই
ইন্শাআল্লাহ।
সহকারী শিক্ষক, হাটহাজারী মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
মন্তব্য করুন: