হেমন্তের প্রথম শুক্রবার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অস্তগামী সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে। আকাশের বুকে ধূসর কুয়াশা। হালকা কুয়াশায় সূর্যের লাল আভা ম্লান। হিম মৃদু বাতাস বইছে। এই হিম বাতাস শীতের আগমনের পূর্বাভাস। কুয়াশার উৎপাতে বিকালটা যেন দ্রুত ফুরিয়ে গোধূলি নেমে এল। একঝাঁক টিয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে অনির মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝাঁপটা দিয়ে উড়ে গেল।
অনি আকাশপানে তাকায়। যতদূর টিয়াদের দেখতে পেল তাকিয়ে থাকে। শহরে টিয়ার এমন ঝাঁক চোখে পড়েনি তার। মেঠোপথ ধরে পাকা ধানক্ষেত পেছনে ফেলে অনি হাঁটছে। অল্প একটু হাঁটলে পৌঁছে যাবে আকন্দবাড়ি। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে ইচ্ছে করেই রিকশা নেয়নি। হালকা শীতের আমেজে গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে বাড়ি যাবে। অনি ছুটি পেলে প্রায়ই চলে আসে আকন্দবাড়ি। শৈশব,কৈশোর,লেখাপড়া শহরে হলেও গাঁয়ের সাথে তার নিবিড় বন্ধন। মা,ভাই না আসলেও অনি একাই চলে আসে।
আকন্দবাড়ির উঠোনে পা রাখতেই চাচির হাস্যউজ্জ্বল মুখটি দেখতে পেল অনি। উঠোনের এক কোণায় ঢেঁকিঘর। ঢেঁকিঘরের সামনে ধানের স্তুপ। অনি কাছে গিয়ে চাচিকে জড়িয়ে ধরল,'এত শুকাইছিস কেন মা?' অনি হেসে বলল, 'তোমার চোখে আমি সব সময়ই শুকনা। আমার কথা বাদ দাও। তোমার শরীর কেমন আছে চাচি?' জুলেখা বেগম বললেন,'ভালো আছি। তোর চাচার শরীরটাই ভালো থাকে না।' জমির আকন্দ অনিকে নিজের মেয়ে মনে করেন।
কিছুদিন পর পর অনিকে দেখতে না পেলে নিজেই অসুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। ব্যস্ততার কারনে অনি যখন আসতে পারে না নিজেকে অপরাধী মনে করে। শেকড়ের টানে,দায়িত্ববোধ থেকে বাড়ির মানুষগুলোকে দেখতে আসে। বাবার,দাদির কবরে পাশে দাঁড়ায়,দোয়া করে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। জমির আকন্দ নামাজ পড়ে বাড়ি আসলেন। অনি ফলের প্লেটহাতে সামনে দাঁড়াল। জমির আকন্দ অনিকে দেখে প্রাণখোলা হাসি দিলেন,'কখন আসছোস মা?' অনি হাসিমুখে জবাব দিল,'এই তো আধঘন্টা আগে। সকালেই চলে যাসনে আবার। দুটো দিন বাড়িতে থেকে যাবি।'
অনি নিঃশব্দে মুচকি হেসে চাচার পাশে বসে বলল ,'আগেরবার যখন ড্রাগন ফল আনলাম তুমি বেশ মজা করে প্লেটের সব টুকরো খেয়ে নিলে। ফলটার নাম জিজ্ঞেস করলে তখন বুঝলাম,নতুন ফল তোমার পছন্দ হয়েছে। আজও সব খাবে।' জমির আকন্দ হাসলেন। জমির আকন্দ ফল খাচ্ছে অনি চাচার সাথে কথা বলছে। এর মধ্য জুলেখা বেগম গরম গরম চিতই পিঠা,হাঁসের মাংস নিয়ে আসলেন।
ছেলে বাড়ি আসবে জেনে তিনি ঝাল ঝাল করে দুটো হাঁস রান্না করে রেখেছিলেন। অনি কথা বলতে বলতে চাচা চাচিকে নিয়ে আয়েশ করে চিতই পিঠা খেল। জুলেখা বেগম বললেন,'ধ্রুবটা চলে আসলে একসাথে পিঠে খাওয়া যেত। দেরি করছে কেন বুঝতে পারছি না।' ধ্রুব আসবে শুনে হঠাৎ এক অজানা ভালো লাগা শুরু হলো অনির ভেতর। ধ্রুবর অভ্যাসের কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে যায় অনির। ধ্রুব সব সময় অনিকে রাগায় যা অনির অপছন্দ। অনি উষ্ণ চায়ের মগহাতে ধীরে ধীরে ধ্রুবর ঘরে এল। জুলেখা বেগম ছেলের ঘরে সবাইকে ঢুকতে দেয় না।
নিজের হাতে ধ্রুবর ঘর গুছিয়ে রাখেন। অনি ঘরে ঢুকেই নাক বরাবর দেয়ালে বাঁধাই করা ধ্রুবর ঝুলানো সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকালো। কি প্রাণবন্ত হাসি! মায়াবী অবয়ব। উসুখুস চুল! অনি বেশ খানিকসময় নিয়ে ধ্রুবকে দেখল। চাচি এসে কখন অনির পেছনে দাঁড়াল অনি বুঝতে পারেনি। কাঁধে হাত রাখতেই অনি চমকে উঠে। সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকায়। চাচিকে দেখে কিছুটা লজ্জা পেল অনি। জুলেখা বেগম হেসে বললেন, 'আমার ধ্রুবটাকে দূরে পাঠিয়ে ভালো থাকতে পারি না রে। ও বাড়িতে না থাকলে এখানে এসে ছবিটা মনভরে দেখি। তার পুরস্কারগুলি মুছে যত্ন করে সাজিয়ে রাখি।' জুলেখা বেগম কথা শেষ চোখ মুছলেন। রাত দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকি।
জুলেখা বেগম পুকুরের কৈ মাছ ভাঁজলেন। জলপাই দিয়ে পুঁটিমাছের ঝোল করলেন। এই পুঁটির টক তরকারি অনির ভীষণ পছন্দ। অনি চাচার জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে আনলো। জমির আকন্দ রাতের খাবার শেষ করে প্রেসারের ঔষধ খেয়ে নিলেন। অনি খাটের মশারি টাঙিয়ে বলল,'চাচা,তুমি এবার আরামে নিদ্রায় যেতে পারো।'ধ্রুবর আওয়াজ পেয়ে জুলেখা বেগম দরজা খুলে দাঁড়ালেন। পেছনে অনি। ধ্রুব মা'কে সালাম দিয়ে ঘরে এসেই অনিকে দেখে বলল,'তুই কখন আসলি কানি?'
জুলেখা বেগম বললেন,'মেয়েটা কতদিন পর বাড়ি এল ওরে রাগাবি না ধ্রুব!' অনি চোখে চশমা পরে তাই রাগানোর জন্য ধ্রুব প্রায় সময়'কানি' বলে ডাকে। জুলেখা বেগম ঝটপট সব খাবার বেড়ে অনি,ধ্রুবকে নিয়ে খেতে বসলেন । ধ্রুব পছন্দের হাঁসের মাংস দেখে কয়েক টুকরো খালি খেল।
অনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, 'তোর বাড়ি আসার কারণ আমি জানি হাঁসের মাংসের লোভেই তুই প্রায়ই বাড়ি আসিস।' অনি রাগে বলল,'চাচি তোমার ছেলেকে আমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করো। তা না হলে সকালে আমাকে এ বাড়িতে আর দেখবে না।'
ধ্রুব এবার চুপচাপ খেতে শুরু করলো।'
অনি ভোরে উঠে বারান্দায় আসে। গ্রামে ভোরের প্রকৃতি অনির ভীষণ পছন্দ। গ্রামের বাড়িতে যে ক'দিন থাকে প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে। চাচির সাথে ক্ষেতের আঁইলপথ ধরে নির্মল বাতাসে হাঁটে। মুক্ত আকাশ দেখে। চাচা,চাচির সাথে বসে মুড়িমাখার সাথে চা খায়। অনি স্যান্ডেলে পা গলিয়ে ধীরে ধীরে সবজির পালানের সামনে দাঁড়ায়। মাচায় হাত বাড়িয়ে লাউয়ের ডলায় শিশিরজল ছুঁয়ে দিল। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে দেখে চাচি দাঁড়ানো।
' চাচি,তোমার লাউগাছে এবার অনেক ফুল আসছে। এবার বাম্পার ফলন পাবে।'
জুলেখা বেগম হাসলেন। এরপর বললেন,'ঢাকা পাঠানোর মানুষ পাই না তো। অনেক শাকসবজি,মাছ পাঠানো যেত।' জুলেখা বেগম থেমে কিছু সময় ভাবলেন। অনিকে আজ সরাসরি তার মনের কথাটা বলবে। অনিও হয়তো ধ্রুবকে নিয়ে আলাদা কিছু ভাবে। নাহলে বাড়ির দিকে মেয়েটার এত টান কেন? শুধুই কি দায়িত্ব,কর্তব্য পালনের জন্য ছুটে আসে? মনে মনে হয়তো ধ্রুবকে পছন্দ করে। চাচির নীরবতা দেখে অনি জিজ্ঞেস করল,'হঠাৎ থেমে গেলে কেন? কি ভাবছো বলে ফেলো।'
জুলেখা বেগম অনির গাল ছুঁয়ে বললেন,'আমার ধ্রুব পাগল ছেলেটাকে বিয়ে করবি?' সাথে সাথে অনির মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মাথা নিচু করে রইল। জুলেখা বেগম আবার বললেন,'আমার ছেলেটা একটা প্রাইভেট জব করে। ছোট চাকরি। তুই ভালো চাকরি করিস। হয়তো ধ্রুব তোর যোগ্য না। দেখিস আমার ধ্রুব তোকে অনেক সুখে রাখবে।' অনি চাচির হাতদুটো ধরে বলল,'চাচি এভাবে বলছো কেন? ধ্রুব ভাই খুব ভালো মনের মানুষ। আমার কোনো আপত্তি নেই।' জুলেখা বেগম খুশিতে অনির কপালে চুমো খেলেন।
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর অনি ধ্রুবর সামনে বেশি পড়ে নি। ধ্রুবকে দেখলেই তার ভেতর কেমন জড়তা কাজ করে। ধ্রুবও আগের মতো অনিকে রাগাতে আসে না। ঢাকা ফেরার সময় ধ্রুব মুচকি হেসে অনিকে শুধু বলল,'সাবধানে যাস। নিজের খেয়াল রাখিস।' অনির মা গ্রামে মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। ছোটবেলা থেকে শহরে বড় হয়ে,লেখাপড়া শিখে গ্রামে কেন তাকে ফিরতে হবে কিছুতেই অনির মা মেনে নিতে পারছেন না। অনি মা'কে বুঝিয়ে রাজি করালো। দুই পরিবারের মুরুব্বিরা বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন।
অগ্রহায়ণ মাসের এক তারিখ অনি ধ্রুবর বিয়ে। কার্তিক মাসের শেষ শুক্রবার অনি ধ্রুবর গায়ে হলুদ। বিয়ে হবে গ্রামে আকন্দ বাড়িতে। অল্প পরিসরে। দুই পরিবার বিয়ের কেনাকাটা,প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। গায়ে হলুদের দু'দিন আগে অনি মা,ভাইয়ের সাথে চলে আসে আকন্দবাড়িতে। অনি মা,চাচিকে বলে রাখছে তার গায়ে হলুদে গাঁয়ের মেয়েরা গীত গাইবে। জুলেখা বেগম নিজের বাবার বাড়ি থেকে দুইজন মেয়েকে আনলেন গীত গাওয়ার জন্য। ধ্রুব সাতদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। কাছের আত্মীয়স্বজন সবাই চলে আসে হলুদ অনুষ্ঠানে।
জুলেখা বেগম নানাপদের পিঠা,পায়েস,মিষ্টি এনে রাখলেন গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে। কাঁচা হলুদ রাঙা শাড়ি,হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি,সিঁদুর রাঙা আলতামাখা পায়ে অনিকে পরীর মতো লাগছে।
গায়ে হলুদের প্রস্তুতি সম্পন্ন। ধ্রুব আসলেই অনি ধ্রুবকে নিয়ে একসাথে হলুদ ছোঁয়াবে। আসার পথে ধ্রুব মায়ের সাথে কয়েকবার কথা বলেছে। ধ্রুব মাকে বলেছে, পথে জ্যাম তাই দেরি হচ্ছে। দেরি দেখে জুলেখা বেগম আবার যোগাযোগ করলেন। ধ্রুবর মোবাইল বন্ধ। ফোন বন্ধ পেয়ে বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে উঠলেন। অনির ভেতরটা বারবার কেঁপে উঠছে। নিজেও কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে।
কথা বলতে পারে নি। দুপুর বিদায় নিয়ে বিকেল গড়িয়ে প্রায় গোধূলিলগ্ন। আকন্দবাড়িতে সুনসান নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে জমির আকন্দের ফোনে কল আসে,' হসপিটাল থেকে বলছি, আপনারা একটু হসপিটালের জরুরি বিভাগে আসুন।'
মুহূর্তের মধ্যে আকন্দবাড়ির সব আনন্দ শোকের মূর্ছনায় ভেসে যায়। অনির গাল বেয়ে নোনাজল টপ টপ করে আলতামাখা পায়ের উপর পড়ছে। স্থির হয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে আঁধারে ঢাকা আকাশের দিকে।
মন্তব্য করুন: