মঙ্গলবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৫, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • গত ১৫ বছর পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল
  • এলজিইডির ৩৬টি কার্যালয়ে দুদকের অভিযান চলছে
  • রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন ছাড়া কিছুই বাস্তবায়ন হবে না
  • প্রবাসীদের ‘ভোটিং সিস্টেম’ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকে ইসি
  • ঢাকায় ৫০ কিমি বেগে ঝড়ের আশঙ্কা
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠন
  • সরানো হলো আরও এক উপদেষ্টার পিএসকে
  • জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদ
  • জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
  • ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন

ভ্রমণ কাহিনী

ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক

রুখসানা গাজী রিনা

প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৬

আমার গল্পটি জার্মানির Freiburg শহরকে নিয়ে যেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল একটা কনফারেন্সের অংশগ্রহণকারী হিসাবে। কোনো একটা নতুন জায়গায় ভ্রমণের আগে সে জায়গা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেয়া উচিত কিন্তু কখনো তা হয়ে ওঠে না। পরে জানতে পেরেছি এই শহরটা অনেক উঁচুতে অবস্থিত এবং ব্ল্যাক ফরেস্টের জন্য বিখ্যাত। জার্মানির একটি গ্রাম Feldberg এ রয়েছে ব্ল্যাক ফরেস্ট পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়া যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৮৯৮ ফিট উঁচুতে। যাইহোক, কনফারেন্সের ওপেনিং ডিনারে সেজেগুজে রওনা দিলাম, হোটেলের রিসিপশনে ঠিকানা দেখাতে ওরা বলল ওয়াকিং ডিসটেন্স।

হায়রে এই নাকি সামান্য দূরত্ব, বিস্তর হাঁটতে হলো ভেন্যুতে পৌঁছাতে, এ তো আর আমাদের দেশ না যে চট করে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। ভেন্যু একটা পুরনো ক্যাসেল একেবারে গা ছমছম করে উঠলো। খাবার-দাবারের আয়োজন দেখে মনে মনে ভাবলাম খাওয়া দাওয়া করে তারপরে আসা উচিত ছিল। নানান রকম কুকি, ছোট্ট পাউরুটির উপরে এক টুকরো বেগুন ভাজা, বিস্কিটের উপরে এক টুকরো সসেজ এসব খাবারে কি বাঙালির পেট ভরে? বুঝলাম, রাত্রে তো খিদেয় ঘুম হবেনা। কিন্তু অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের কে দেখলাম উচ্ছল- উজ্জ্ল, হাসিখুশি আর চলেছে পানীয়ের ফোয়ারা। হুম্, এই তাহলে আনন্দের উৎস।

সফরসঙ্গী ছিলেন আমার বস, উনি এক বিদেশিনী মহিলা, প্রথম দিন কনফারেন্স শেষে বললেন তিনি তার বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার আনতে ভুলে গেছেন যার অভাবে তিনি সমস্যায় পড়েছেন। কি আর করা, বসের সাথে ঘুরে ঘুরে দোকান থেকে তার শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার খুঁজে বের করতে হলো। আমাদের দেশের দোকানের মতো কাস্টমারের বসার কোন ব্যবস্থা নেই যার জন্য হেঁটে হেঁটে পা প্রায় ব্যথা হয়ে গেল। যারা অফিসিয়াল ট্যুরে অভ্যস্ত তারা জানেন যে অফিসিয়াল ট্যুরে গেলে পদমর্যাদা অনুযায়ী থাকা খাওয়ার খরচ দেয়া হয়। যেহেতু আমার বস উচ্চ পদে আছেন তিনি ফাইভস্টার হোটেলে ছিলেন আর আমি কনফারেন্স হল থেকে একটু দূরে একটা গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিলাম তাই আমাকে প্রতিদিন ট্রামে করে কনফারেন্স হলে যেতে হতো। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালই হয়েছিল, আমার গেস্টরুমের জানলা দিয়ে তাকালে একটা ছবির মত সুন্দর বাড়ি এবং তার সুন্দর লনটা পুরোটাই দেখা যেতো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম পরিবারটি কিভাবে অবসর সময় তাদের বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করছে (যাকে আমরা বলে থাকি কোয়ালিটি টাইম)। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে খেলতে দিয়েছে এক বাক্স বালু, পানি এবং পাথর। দেখতাম বাচ্চা গুলো দুহাত ভরিয়ে বালু আর পানি ঘাটাঘাটি করে খেলা করছে। ভাবলাম আমাদের দেশে আমরা তো বালুকাদা থেকে বাচ্চাদেরকে সবসময় দূরে দুরেই রাখি। একদিন সন্ধ্যাবেলায় একটা শপিং মলে গেলাম কিছু উপহার সামগ্রী কেনার জন্য, আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার হলো, চোখে পড়ল স্কুলপড়ুয়া তিন-চারটি মেয়ে ওয়াশরুমে একসাথে সিগারেট খাচ্ছে। মনে মনে ভাবছিলাম আপাতসুন্দর ও সুশীল একটা সমাজে ও নির্বিচারে সবকিছু হয়তো ভালো হয় না।

যাই হোক, কনফারেন্সের শেষের দিন একটা ট্যুর অফার করা হলো। তিন রকমের অপশন ছিল। একটা হচ্ছে বাসে করে লং ড্রাইভে ইতালির বর্ডারে যাওয়া, ব্ল্যাক ফরেস্টে ট্রেকিং/হাইকিং করা এবং তৃতীয়টি ব্ল্যাক ফরেস্টে হাঁটতে যাওয়া (এটা মূলত বয়স্ক ও বাচ্চাদের জন্য)। আমি আর কি করবো তৃতীয় অপশনটি বেছে নিলাম। ট্রেনে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ছোট্ট একটা গ্রামে সেখান থেকে পাহাড়ি পথ শুরু। সুন্দর বাঁধানো পাকা রাস্তা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে। বুদ্ধদেব গুহের গল্পের ভাষায় পাহাড়ি পাকদন্ডী। শুরুতে ভালই লাগছিল কিন্তু ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো, পায়ে টান ধরল। আমাদের গ্রুপের একটা ইরানি পরিবার তাদের দুটো বাচ্চাকে দিব্যি হাত ছেড়ে দিলো যারা দৃষ্টির সীমানার বাইরেই হাঁটছিল, ভাবলাম এদের কত সাহস। হঠাৎ ঘন কালো মেঘ ঝুপ ঝুপ করে এসে সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল, ঘুটঘুটে অন্ধকার, সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না, এজন্যই বোধহয় এর নাম ব্ল্যাক ফরেস্ট। ইরানি বাচ্চা দুটোর কথা মনে করে চিন্তা হচ্ছিল।

পায়ে হিল জুতো, কেমন করে এত রাস্তা পাড়ি দেই? এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কেন অর্গানাইজাররা দেশ থেকে বুট জুতো আর ছাতা আনতে বলেছিল, কথা তো শুনিনি। সত্যি আর পেরে উঠছিলাম না, হাঁফাতে শুরু করলাম, বারবার ভিজে যাচ্ছিলাম। এক বিদেশী ভদ্রলোক নিজের মাথায় জ্যাকেটের হুড তুলে দিয়ে তার ছাতাটা আমাকে অফার করল। বহু কষ্টে পথ শেষ হলো পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় একটা রেস্টুরেন্টে। একটু কফি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। সবার দেখাদেখি ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক কিনে খেলাম, সে এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। ব্ল্যাক ফরেস্টে বসে আসল ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক খাওয়া। শুনলাম রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা সন্ধ্যা হলেই পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামে চলে যায় কারণ প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। পাহাড়ি পথে নামার সময় ভাবছিলাম এমন নির্জনে আমার ঘর বাড়ি হলে কেমন লাগতো? যে মানুষের দিন যায় সারাক্ষণ কারণে অকারণে হর্ন বাজার শব্দ শুনে, রিক্সার আওয়াজ শুনে, মাইকের অত্যাচার সহ্য করে তার জন্য এই নির্জনতা? নাহ্, বোধহয় বেশি দিন এমন নির্জনতা পোষাতো না। শব্দদূষণে আর কোলাহলে ভরা, সরল সাধারণ মানুষে ঘেরা দেশী ছোট্ট নীড়টাই আমার জন্য সেরা।

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর