প্রকাশিত:
৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:০৬
ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি,একটা অন্য রকম অনুভূতি মনের ভিতরে কাজ করছে। সচরাচর আমি মোংলা হতে বাসায় গেলে খুলনা হতে ট্রেনেই নীলফামারী যাই! সে বছর শতচেষ্টা করেও আর ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ করা গেলোনা। বাধ্য হয়েই বিআরটিসির বাসে চেপে বসলাম।
বাস জার্নিতে সবসময়ই জানালার পাশের সিটই আমার পছন্দ। তাই এবারও টিকেট কাউন্টারে বলে,জানালার পাশের সিটের টিকেট নিয়ে বসে পরলাম। বিকেল ৪.৩০ মোংলা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে বিআরটিসি রওনা দিলো!
গাড়িতে হালকা ভলিউমে পুরোনো দিনের রোমান্টিক বাংলা গান বাজছে,আর সো সো শব্দে বিআরটিসি বাস এগিয়ে চলছে। গানের তালে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি,মনে পড়ছে না। হঠাৎ ই এক সুরেলা কন্ঠের মেয়েলি আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো!
ভাইয়া যদি কিছু মনে না করেন,আমি কি আপনার সীটে বসতে পারি? আমার দূরের জার্ণিতে একটু মাথা ঘোরে,বমি বমি লাগে! জানালার পাশে বসলে সমস্যা হয়না!
_ আমি তো ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে দেখি,গাড়ি খুলনা নিউমার্কেটের সামনে দাড় করানো। তার মানে এ মেয়ে এখানেই থাকে হয়তো!
আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা! সখের সিট কি ছেড়ে দিবো! মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা মায়া লাগছে! নিমিষেই মনে হলো সে যেন আমার অনন্ত কালের পরিচিত। অগত্যা কিছু না ভেবেই বলে বসলাম বসুন!
মেয়েটি জানালার পাশে আমার সিটে গিয়ে বসলো আর আমি তার পাশেই তার সিটে বসলাম! মেয়েটি যেনো একটু বেশিই খুশী হলো! আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলা শুরু করলো!
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! আমার জন্য আপনার সিটটা ছেড়ে দেয়ার জন্য।
_ ইটস্ ওকে! আমি যেকোনো সিটেই সাবলীলভাবে যাত্রা করতে পারি।
জানেন ভাইয়া,আমি বাসে করে দীর্ঘ জার্ণি করতে পারিনা। মাথা ঘোরে আর বমি বমি লাগে!
_ অনেক মেয়েদেরই তাই মনে হয়!
হুম! তাই আমি নিয়মিত ভাবে ট্রেনেই যাওয়া আসা করি! আগে থেকেই সীমান্ত এক্সপ্রেসের সিট বুক করে রাখি! এবারও এক বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম,ও টিকেট কেটে রাখার কথা! হঠাৎ দু'দিন আগে জানালো টিকেট কাটা হয়নি,বলেন তো কার ভালো লাগে!
আমি মেয়েটির কথা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছিলাম আর ভাবছিলাম মেয়েটির সাথে আমার সবকিছুতেই কেন এতো মিল! মেয়েটাকে এই কয়েকটা মিনিটে যত দেখছি ততো বেশি ভালো লাগছে কেন?
তার খোলা চুলের ঘ্রাণ,তার মুখের কথা,তার মিস্টি হাসি সবকিছুতেই যেনো আলাদা একটা মায়া কাজ করছে,যা সৃষ্টির আদি রহস্যেই ঘেরা! এ রহস্য আমার মতো ছাপোষা মানুষের জানার কথা নয়।
একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করছি,কিন্তু হঠাৎই মেয়েটি ঘুমিয়ে পরলো! বাস দূরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে,আর খোলা জানালায় বাতাসের সাথে তার চুলগুলো উড়ছে,এ এক অন্যরকম দৃশ্য। সত্যিই মেয়েদের খোলা চুলের মাঝে এতো বেশি সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তা আগে কখনোই জানা হয়নি! তার চুলের কিছু অংশ আমার মুখের উপরে বারবার এসে পরছে। অনেক সময় ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে,তবু সাহস হচ্ছেনা ছোঁয়ার,যদি মেয়েটি টের পায়!
বিআরটিসি বাস আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে,আর আমি অচেনা এই মেয়েটির মুখপানে চেয়ে চেয়ে আছি! কখন যে রাত দুটো বেজে গেছে টেরই পাইনি। হঠাৎই বাসটা থেমে গেলো,কন্ট্রাক্টর সবার উদ্দেশ্যে বললেন যে যার মতো খেয়ে নিন! ২০ মিনিট পরে আমরা আবারও পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো!
এখনো মেয়েটা একমনেই ঘুমোচ্ছে,তাকে কি জাগিয়ে তুলবো,আবার যদি রাগ করে বসে! অপরিচিত মেয়ে ঠিকতো নাই। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে কিছু খাওয়া দরকার! কিন্তু হোটেলে খেতে গেলে তো মেয়েটাকে অপলক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ হারাবো। যদিও সারা পথ ধরে তাকে আড়চোখে দেখে দেখে এসেছি,বাসভর্তি প্যাসেঞ্জার কে কী ভাববে এই ভয়ে! কিন্তু এখন তো পুরো বাসটাই খালি,এখন বাসে শুধু আমি আর আমার পাশে বসা স্বপ্নের রাজকন্যা! এখন চাইলে তার দিকে তাকিয়ে হাজারো রাজ্য হারানোর স্বপ্নে বিভোর হওয়া যায়! এখন তো আসেপাশে বিরক্ত করার মতো কেউ নেই। এদিকে ক্ষুধার মাত্রাও চরমে। তবে এখন কি করবো,কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা! অনেক ভেবে চিন্তে,দ্রুত নেমে গিয়ে কলা,পাউরুটি ও হাফ লিটার জুস নিয়ে আবারও বাসে এসে বসলাম! এখনো মেয়েটি আগের মতোই ঘুমোচ্ছে,মনে হয় কতদিন যেন না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে! আর তার ঘুমহীন চোখের কি এক আলাদা মায়া তার মুখের লাবন্যটা বহুগুন বাড়িয়ে তুলেছে।
অনেক ভেবে চিন্তে মেয়েটি কে ডাকলাম, এই যে শুনছেন,কিছু খাবেননা?
_ ও হুম! ঘুমের ঘোরেই মেয়েটি জবাব দিলো!
তাহলে উঠুন,কিছু খেয়ে নিন,নয়তো শরীর খারাপ করবে।
মেয়েটি উঠে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,মনে হচ্ছে সে যেনো জন্ম জন্মান্তর ধরেই আমার পরিচিত। আমি একটু লজ্জায় পরে গেলাম,সেটা হয়তো মেয়েটা বুঝতে পেরে একটু মৃদু হাসি দিলো। এবার আমার ঘোর কাটল,বললাম নিন কিছু খাবেন!
_ আমার জন্য এতো কষ্ট করার কী দরকার ছিলো?
না এতোটা পথ একসাথে আসলাম,আপনার প্রতি তো একটা দায়িত্ব আছে! তাই প্রথমে ভাবলাম হোটেলে খেয়ে আপনার জন্য কিছু নিয়ে আসবো,পরে ভেবে দেখলাম এতে শেষ পযন্ত না আপনি আমাকে মলম পার্টির লোক ভেবে বসেন।
_ না ঠিকই ভাবছেন,তবে আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় অনেক ভালো একজন মানুষ আপনি! না হলে কী আর এমনি এমনি সহজে নিজের আসন কেউ ছেড়ে দেয়!
আসলে আপনি যেমনটা ভাবছেন আমি কিন্তু অতটা ভালো মানুষ নই!
_ তাই!
হুম,অনেকেই বলেন আমি নাকি নিজের স্বার্থ ছাড়া তেমন কিছু বুঝিনা!
_ তাহলে একটা প্রশ্ন করি,আপনি কোন স্বার্থে আপনার আসনটা আমার সাথে পরিবর্তন করলেন!
এটা তো অনেক কঠিন প্রশ্ন তবুও বলি,আপনি অনেক সুন্দর;না স্যরি সুন্দরী! তাই যেকোনো যুবকই আপনাকে তাই করতো! আমিও হয়তো এর ব্যতিক্রম নই!
_ হা হা হা,তাই নাকি?
হুম, সত্যিই আপনি অনেক সুন্দরী! এজন্যই আপনাকে আমার সিট ছেড়ে দিয়েছি!
_ এতে আপনার লাভ?
লাভ তো একটা আছে! আপনি যখন খোলা জানালার পাশে বসবেন,তখন প্রচন্ড বাতাসে আপনার খোলা চুলগুলোও দুরন্ত বাতাসের সাথে উড়বে তখন আপনাকে আরও কতটা লাবন্যময়ী লাগে এটা দেখার লোভের জন্য!
_ তো দেখেছেন?
হুম,সারাটা পথ শুধু আপনার সুন্দর মুখ আর খোলা চুলের খেলা দেখতে দেখতেই তো আসলাম!
_ তবে এ কাজটা কিন্তু আপনি ঠিক করেননি,খুব বেশী অন্যায় করেছেন!
যেহেতু ভুল করেই ফেলেছি
তাহলে এখন কী উপায়?
_ এখন একটাই উপায় আছে,আপনি বাকি পথটুকু আমার সাথে এভাবে গল্প করেই কাটিয়ে দিবেন,ঘুমোতে পারবেননা! তবে একটা শর্ত ভুল করেও প্রেম,ভালোবাসা সংক্রান্ত কিছু বলতে পারবেননা। অলরেডি আমি একজনের প্রেয়সী!
বাস আবারও চলতে শুরু করলো! চারদিকে গাছপালাগুলো রাস্তার বিপরীত পাশে ছুটে চলছে। বাসের মধ্যে শ্রীকান্তের গান বাজছে হালকা ভলিউমে। আর পাশের যাত্রীর ঘন কালো চুল হাওয়ার সাথে দোল খাচ্ছে,এ এক অন্যরকম দৃশ্য। এ অপরূপ দৃশ্য লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করেও দেখা সম্ভব নয়! আর এখন তার মুখে দিয়ে যেনো কথার ফুলঝুড়ি ছুটছে। হয়তো অনেকদিন কারও সাথে মন খুলে কথাও বলেনি! আর আমি একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে শুনেই যাচ্ছি,কেননা বিজ্ঞজনদের কথা মেয়েদের প্রেমে পরলে আগে সেই মেয়ের শ্রোতা হতে হয়! সে যাই বলুক সেটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। মেয়েরা এটাকেই ছেলেদের সবচেয়ে বড়গুণ হিসেবে বিবেচনা করে! তাই আমিও সে পথেই পা বাড়ালাম! তার কথা শুনছি আর অজানা স্বপ্নের মায়াজালে হারিয়ে যাচ্ছি।
তার কথার মাঝে মিস্টি হাসি লেগেই আছে,এ যেন মোনালিসার সেই জগৎ বিখ্যাত হাসিকেও হার মানাবে। অথচ এ হাসি কালকে আমার জন্য থাকবেনা! এই পথ ফুরোলে এ হাসিটা অন্যকারো। কিন্তু স্রষ্টা চাইলেই তো এ হাসিটা আজীবন আমার জন্য বরাদ্ধ রাখতে পারে। কী জগতের আজব লীলাখেলা,বিশ্ব চরাচরে যা আপনি একান্ত আপন করে চান,তা অন্যকারো সম্পত্তি। অথচ কত যুগ ধরে যে এই একটি হাসির ছবি হৃদয়ে লালন করে বছরের পর বছর এমন একজনকে খুঁজে ফিরছি। অথচ এ হাসি আমার নয়,অন্যকারো!
সত্যি জগতের রহস্যটা বোঝা অনেক কষ্টসাধ্য! সত্যিই কি এই মেয়ে অন্য কারো প্রেয়সী নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছে! আমি চাইলেই কী তাকে আমার প্রেমের বাগানে ফুল হিসেবে ফোঁটাতে পারবো? তাহলে এ মেয়েটার প্রতি আমার এতো আকর্ষণ হচ্ছে কেন?
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে! দূরের মসজিদে মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে! মনে হয় আর খন্টাখানেকের মধ্যেই গোবিন্দগজ্ঞ পৌঁছে যাব!
আমি এখানে আসলেই আল্লাহর নাম জপ শুরু করি! কেননা এখানে মাঝেমধ্যেই প্রচন্ড জ্যাম হয়,এমনো হয়েছে এখানে চার থেকে পাঁচঘন্টাও গাড়িতে বসেই কাটিয়ে দিতে হয়েছে। আর এ জ্যামগুলো কেন জানি আমার চলার পথেই একটু বেশি ঘটে। আজও আল্লাহর নাম জপলাম,তবে আজ একটা বিশাল জ্যাম যেন থাকে তার জন্য! আমি হয়তো তাকে আপন করে কোনদিনই পাবোনা,কিন্তু আজকে অন্তত কয়েকটি ঘন্টাতো একান্তভাবে তাকে কাছে পাব! আর তার মুখের কথা,হাসি আমার অতৃপ্ত হৃদয়ের ব্যাংকে জমা করে রাখবো।
একটু পরেই কন্ট্রাক্টরের আওয়াজ,কেউ গোবিন্দগঞ্জে নামার আছে? কেউ নামার মতো নাই,তাই আবারও গাড়ি চলতে শুরু করলো! আজ কি আচার্য ব্যপার সারারাস্তায় কোনোখানেই জ্যামেই পরলামনা! যশোর নওয়াঁপাড়ায় যেখানে কমন দুই থেকে তিন ঘন্টার জ্যাম থাকে সেখানে পাঁচ মিনিটও জ্যাম ছিলোনা,এখানেও আজ জ্যাম নেই। আর আজ যেনো ড্রাইভারের স্ট্রেয়্যারিং এ জোরও বহুগুণ বেড়ে গেছে কত স্পিডে চালাচ্ছে,একটু ধীরে চালালে কি এমন ক্ষতি হয়! একটু পরেই তো রংপুর পার হয়ে তারাগঞ্জ,তারপরেই তো আমাকে নেমে যেতে হবে স্বপ্নের এই পথচলা থেকে! হয়তো চলার পথে কখনও তার সাথে দেখা হতেও পারে,হয়তো আর কখনোই দেখা হবেনা। এরচেয়েও ভালো হতো যদি এ পথচলা কভু শেষ না হতো,অনন্ত কাল ধরেই এ ভ্রমন চলতেই থাকুক! আমি আর সে পাশাপাশি,কাছাকাছি। সত্যিই কী এমন হতে পারেনা? জগতে তো কতকিছুই ঘটে। যদি আবারও এ পথচলা মোংলা হতে শুরু হতো তো আবারও একটা রাত তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারতাম।
এমন সময় কন্ট্রাক্টরের ডাক,ভাই আপনি না বলছিলেন তারাগঞ্জে নামবেন? অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি, জলদি নামুন।
ব্যগটা কাধে নিয়ে নেমে পরলাম,তার নামটাও আর জিজ্ঞেস করলাম না! যে আমার হবেইনা কখনও কোনো দিন,তবে তার নাম হৃদয়ে লালন করে লাভ কী! শুধু শুধু হৃদয়ে জ্বালা বাড়ানোর দরকারটা কী! এরচেয়েও এই ভ্রমন স্মৃতি যত দ্রুতই ভুলে যাওয়া যায় সেটাই মঙ্গল! তবুও নামার সময় শেষ বারের মতো সেই মুখটা একবার ফিরে দেখে নিলাম! সে হাত সাড়া দিয়ে শেষ বারের মতো মৃদু হাসলো। তার সে হাসির রহস্যটা অচেনাই থেকে গেলো!
লেখক ও এনজিও কর্মী, কিশোরগঞ্জ,নীলফামারী।
মন্তব্য করুন: