প্রকাশিত:
৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:০৮
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ, এমবিএ ও পিএইচডি করার সুবাদে বর্ধমান শহর দীর্ঘদিনের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। এই সময়ে নানা ঐতিহাসিক স্থানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে, কিন্তু পলাশীর প্রান্তর দেখা ছিল একেবারেই অন্যরকম এক আবেগঘন অভিজ্ঞতা। পলাশীর নাম শুনে বড় হয়েছি ইতিহাসের পাতায়, যেখানে বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল। সেই স্থানের মাটিতে প্রথমবার পা রাখার অনুভূতি ছিল মনে গভীর আলোড়ন তোলার মতো।
একটি শান্ত সকালে, ইতিহাসের স্বপ্নময় প্রেক্ষাপটে যাত্রা শুরু করি। পলাশীর প্রান্তরে পৌঁছানোর পর যেন সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল। প্রান্তরের বিস্তৃত মাটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম, এই স্থানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বাংলার সেই নির্ধারণকারী যুদ্ধ, যা একটি জাতির ভাগ্যকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এই মাটি বুঝি এখনও ইতিহাসের কান্না ধরে রেখেছে।
সেখানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিলাম ১৭৫৭ সালের সেই মুহূর্তগুলো। সেনাদের পদশব্দ, কামানের গর্জন, আর বিশ্বাসঘাতকতার করুণ আর্তনাদ যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। পলাশীর প্রান্তর তখন কেবল একটি স্থান নয়, বরং বাংলার ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে উঠল আমার কাছে। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি, যেখানে শোক আর গৌরবের মিশ্রণ ঘটে যায় মনের গভীরে।
প্রান্তরের চারপাশে কিছু গাছপালা আর স্থানীয় গ্রাম্য পরিবেশ যেন সেই সময়ের স্মৃতিকে আরও জীবন্ত করে তোলে। ইতিহাসের পাঠশালায় পড়া সিরাজউদ্দৌলার সেই করুণ পরাজয়ের গল্প আর মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা মনে পড়ে মনের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ আর দুঃখ জাগিয়ে তোলে। অথচ সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আবার এক ধরনের মুগ্ধতা অনুভব করি—কীভাবে এক সময় এই স্থান বাংলার শাসনব্যবস্থার নিয়ন্তা হয়ে উঠেছিল।
পলাশীর প্রান্তর দেখে মনে হয়েছিল, ইতিহাস কখনো পুরনো হয় না। তা আমাদের চেতনায় নতুন করে জেগে ওঠে। প্রান্তরের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম একটি সময়ের ছায়া, যা আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষমতা, লোভ আর বিশ্বাসঘাতকতার ফলাফল। এই স্থানে একদিকে যেমন বেদনাবোধ হয়, অন্যদিকে আবার আত্মসমীক্ষার সুযোগও মেলে—এখন আমরা কতটা ইতিহাসের সেই শিক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছি?
সেদিন পলাশীর প্রান্তরে এক দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটলাম। একদিকে ইতিহাসের গৌরবময় রূপ, অন্যদিকে ক্ষতির ক্ষত নিয়ে মাটি যেন আমার সঙ্গে কথা বলছিল। প্রান্তরের নীরবতা ভেদ করে ভেসে আসে সেখানকার স্থানীয় মানুষের জীবনধারা। কেমন সহজেই তারা এই ঐতিহাসিক স্থানের পাশে বসবাস করছে, যেন এই মাটি তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অংশ।
পলাশীর প্রান্তর দেখে ফিরতে ফিরতে বুঝতে পারছিলাম, এই স্থান আমার জীবনে এক বিশেষ স্মৃতি হয়ে থাকবে। এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, বরং বাংলার আত্মপরিচয়ের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়, যা আমার মনের গভীরে চিরকালীন প্রভাব রেখে গেছে।
পিএইচডি গবেষক, প্রশাসন বিভাগ ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।
মন্তব্য করুন: