প্রকাশিত:
২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৩
রান্না ঘরে গিয়ে রিয়ার গম্ভীর চেহেরা দেখে রাত্রি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল-”তোর উত্তম কুমারকে দেখলাম মর্নিং ওয়ার্কে যেতে।”
-”প্রতিদিনই যায়।” রিয়ার স্বাভাবিক জবাব
-”সেতো ফুলবাবুর সব খবরই আমি জানি। কিন্তু ফুল বাবুগিরী আর কতদিন চলবে?” একটু রসিকতা রাত্রির
-”তুই ফুলবাবু ফুলবাবু করছিস কেন? ওর একটা নাম আছে।”-”ঠিক আছে, সাঈদ ভাই-ই বললাম। কিন্তু সে এখনো কিছু করার নামই নিচ্ছে না, ব্যাপারটা কি? হাবভাব দেখে মনেও হয় না কিছু করার ইচ্ছে আছে। বাবার আদরের সন্তান, বাবার হোটেলে বসে খাচ্ছে। নিয়মিত রূপচর্চাও করে মনে হয়। পাখি যেদিন উড়ে যাবে….” রাত্রি কথাটা শেষ করার আগেই রিয়ার ধমক-”তুই চুপ করবি?”
-”করলাম চুপ। তা সিস্টার তোমার হেলপারকে দেখলাম ফোস ফোস করে চলে যেতে।” হেলপার মানে কাজের বুয়া।
- ”ভুল দেখিসনি।”
- ”রান্নাঘর সামলাবে কি করে?”-”তোকে ভাবতে হবে না।”
-”ওকে। তবে যদি মনে করিস আমার হেল্প লাগবে, তাহলে ডাকিস। আমি গেলাম।”
রাত্রি ড্রয়িংরুমে এসে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে। বকুল ভাই সোফাতে বসে আছে। বকুল বলল –”এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, মনে হচ্ছে ভূত দেখেছো?”
-”আপনার আসাটাতো ঐরকমই। দরজা খুললো কে?”
-”দরজা খোলাই ছিল। গেটটাও খোলাই পেয়েছি। আশেপাশে কোথাও তোমাদের দারোয়ান কাম মালিকে দেখিনি। এভাবে দরজা খোলা রাখা ঠিক না। আজকাল চোর চেনা যায় না। এই যে আমি এতক্ষণ ধরে বসে আছি কেউ কিছুই জানে না। ইচ্ছে করলে অনেক কিছু নিয়ে চলে যেতে পারতাম।”
-”নিলেন না কেন?”
-”ঠাট্টা নয় রাত্রি।সাবধানে থাকা ভালো। বাসায়তো কাউকেই দেখছিনা। রিয়া, রিমি, রায়ান এরা কোথায়? মামা বাসায় নেই? তোমাদের কাজের ছেলেটাইবা কোথায়? তুমি বাসায় কেন ভার্সিটিতো খোলা? অযথা বাসায় বসে আছো কেন?”
রাত্রির ধারণা যারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে তারা উত্তর পাওয়ার আশায় করে না। বকুল ভাইও নিশ্চয় উত্তরের আশা করছে না। তা না হলে লেজ লাগানো এতোগুলো প্রশ্ন করতো না। বকুল নামটার মধ্যে মেয়ে মেয়ে একটা গন্ধ আছে। বকুল ফুলের সাথে খুব সহজেই মেয়েদের তুলনা করা যায়। পুরুষদের করা যায় না। শিউলি,চামেলি, বেলী, মালতি আরো অনেক ফুল আছে। এই জাতীয় নাম যদি কোনো পুরুষের হয়, তাকেতো পুরুষ বলেই মনে হবে না । মূহুর্তের মধ্যে ভাবনাগুলো ভাবতে ভাবতেই রাত্রির ঠোটের কোণে একটু হাসি ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল। অনেক দিনের একটা সুপ্ত ইচ্ছা বকুল ভাইকে জিজ্ঞেস করবে তার নাম কে রেখেছে। বকুল তাদের দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাই।
রাত্রি বলল-”বকুল ভাই, আপনার নামটো কে রেখেছে? বিচ্ছিরি লাগে। আপনার খারাপ লাগে না?”
বকুল তার নাম নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট না। ফুলের নামে নাম হবে মেয়েদের। কোমল, শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েদেরকেই ফুলের নামে মানায়। পুরুষদের মানায় না। বকুল রাত্রিকে এড়িয়ে যেতেই চেয়েই এই সময়টাকে বেছে নিয়ে এ বাসায় এসেছিলো। রাত্রি আজ ভার্সিটি যায়নি বকুল তা জানতো না। সে বলল-”বিচ্ছিরি লাগবে কেন? ফুলের নামে নাম, নিজেকে পবিত্র পবিত্র লাগে। আমার নানী মৃত্যুর আগে মাকে বলে গিয়েছিলেন আমার নাম যেন বকুল রাখে। মৃত মানুষের কথা রাখতে হয়।”
-”হাদীস-কোরআনের কথা?”
- ”শোনা কথা।”
-”বিশ্বাস করেন?”
-”মুরুব্বিদের কথায় বিশ্বাস রাখতে হয়।”
-”এসব আপনাকে মানায় না।”
-”আমাকে মানানো বা না মানানোতে কিছু আসে যায় না। বেশ কিছুটা বড় হওয়ার পরে জেনেছি বকুল একটা ফুলের নাম। আরো পরে জেনেছি ফুলের নামে মেয়েদের নাম হয়। তখন আর আমার করার কিছু ছিল না।”
- ”আমার ধারণা আপনার নানীজান বেঁচে থাকলে আপনার নাম বকুল হতো না। আপনার নানীজানের ধারণা ছিল তার নাতনী হবে। তাই তিনি ফুলের নামে নাম রাখতে বলেছিলেন। তার বোধহয় নাতনীর খুব সখ ছিল।”
বকুলের নাম নিয়ে প্যাচাল ভালো লাগছে না, তার ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধা সামান্য বা যেমন তেমন না। সকালে না খেয়ে এসেছে সে। গতকাল রাতেও অনেকটা না খাওয়ারই মত। সে রাতে হোটেলে খেতে গিয়েছিল। ভাঙ্গাচোড়া হোটেল। এই হোটেলের নাম "মাছে ভাতে বাঙ্গালী"। এই "মাছে ভাতে বাঙ্গালী"তে সে সব সময় খায। তার সাথে মেসে আরেকজন থাকে। চরিত্র বেশি সুবিধার না। বুয়া রাখতে সাহস হয়না, তাই এই হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা সে-ই করেছে। "মাছে ভাতে বাঙ্গালী"তে আবার রাত দশটার মধ্যে মাছ ভাত সবার পেটে চলে যায়। তার গতকাল রাতে খেতে যেতে এগারটা বেজে গিয়েছিল। ঝাঁপি ফেলে দিচ্ছিলো হোটেল মালিক । বকুলকে দেখে হোটেল মালিক বলল-”ভাই, কিছুইতো নাই, তয় আপনে বসেন আমি দুই ছটাক চালের ভাত বসাইয়া দেই। বেশি সময় লাগবো না। ভাতের ভেতর আলু সিদ্ধ দিমু আর একটা ডিম ভাজমু, বকুল ভাই, চলবো না?”
বকুল মনে মনে বলল-” চলবে না মানে, একশবার চলবে। এখান থেকে না খেয়ে গেলে সারারাত না খেয়ে থাকতে হবে। ক্ষুধা নিয়ে ঘুমানো যায় না। শুধুই ছটফটানি।” মুখে বলল- ”ভাই আপনি আমার জন্য এতো কষ্ট করবেন…”
হোটেল মালিক বলল- ”কিযে বলেন ভাই, কষ্ট আরকি? তারপর কী ভেবে বলল- আইচ্ছা ঠিক আছে, আপনে যখন কইতাছেন তয় থাক ভাই। পরোটা আর তরকারীর ঝোল আছে। ঐগুলানই একটু খাইয়া যান। ক্ষুধা লইযা ঘুমানো ঠিক না।”
এবার বকুলের খুব আফসোস হলো। গরম ভাত, আলুর ভর্তা, ডিম ভাজির কথা শুনে ক্ষুধা আরো বেড়ে গিয়েছিলো তার। পারোটা খেতে বসে নিজেকে মনে মনে গালি দিয়েছিলো। টক পরোটা গলা দিয়ে নামানো যাচ্ছিলোনা। মনে হয় সকালের বাসি পরোটা। সামান্য সৌজন্যবোধের এই তার পরিণাম! কী দরকার ছিল তার ফর্মালিটি দেখানোর। আফসোস নিয়ে খাওয়া শেষ করেছল কোনোমতে।
এখন তার বলতে ইচ্ছে করছে-”রাত্রি তাড়াতাড়ি ভাত দাও।”
রাত্রি বলল-”বকুল ভাই, চা খাবেন?”
বেলা এগারটায় চায়ের কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। ভাতের কথা কেউ বলবেনা। এ বাড়ির সবার সাথে সে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। কেবল রাত্রির সামনেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ে বকুল। মেয়েটা তার অসহায় অবস্থা সব সময় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। তাই তাকে সহজ কথাটাও সহজ করে বলতে পারেনা বকুল।
তার চাকরির এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা আসবে আসবে করেও আসছে না। থানা শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি পেয়েছে। শুধু এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটাই এখনো আসছে না। আসছে আসছে করেও কতদিন হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে চাকরি না হওয়ার চেয়ে, হওয়ার ঝামেলাই বেশি।
দুপুরের আগে পেটে ভাত পড়বে বলে মনে হলো না বকুলের। দুপুর হতে এখনো দু’ঘন্টা বাকি। এ বাসায় দুপুরের খাবার দেয়া হয় ঠিক একটায়। অবশ্য দশ পনের মিনিট এদিক সেদিকও হয়। মনে মনে রাত্রির সাথে সে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মুখোমুখি হলেই তার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। রাত্রি কি বুঝতে পারে, ভার্সিটি থেকে অনার্স মাস্টার্স করে থানা শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি পাওয়া একটা ছেলের এই মেয়ের কাছে কেন এতো জড়তা? বকুলের খুব গরম লাগছে। অথচ এখনো শীতকাল যায়নি।
-”বকুল ভাই আপনি এতো ঘামছেন কেন?”
-”গরম লাগছে।”
-”তাহলে থাক, গরমের মধ্যে চা খেয়ে কাজ নেই।”
বকুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই মেয়েটা কি ইচ্ছে করেই এমন করছে? এই বাড়িতে চায়ের সাথে নাস্তা আসে ট্রে ভরে। নাস্তা খেয়ে খুব সহজেই দু’য়েক বেলার ভাত না খাবার অভাব পুষিয়ে নেওয়া যায়, তার প্রায় দু'বেলা না খেয়ে থাকার অভাবটা সে পুষিয়ে নিতে পারতো।
এই মেয়েকে একটু চমকে দেয়া যায়। সে রাত্রিকে বলতে পারতো-”রাত্রি যাও ফ্রিজের ঠান্ডা পানিতে একটা পুরো লেবু দিয়ে হাফ লিটার শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো।” কিন্তু সে বলতে পারছে না, এই মেয়েকে সে বলতে পারবে না। মনে মনে সে রাত্রির সাথে অনেক গুছিয়ে কথা বলে সবসময়। মুখোমুখি হলে সে রাত্রির চেহেরার দিকেও ভালো করে তাকাতে পারেনা। রাজ্যের জড়তা এসে ভর করে তার উপর।
ক্ষুধার ভাবটা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। বলতে গেলে কাল দুপুরেই যা চারটে খেয়েছিলো। আয়নায় সকালে দেখলো চোখের নিচে গাঢ় কালি পড়েছে। গাল ভাঙ্গা। এরকম চেহেরা নিয়ে এ বাড়িতে আসার ইচ্ছা তার ছিলো না। আসবেনা আসবেনা করেও কেন যে সে সবসময় এখানে চলে আসে! নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে। অসহায় মানুষদের দেখতে এরকম বোকা বোকা লাগে। তাকেও কি সে রকম লাগছে!
রাত্রি বলল-”বকুল ভাই আপনাকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে।”
আশ্চর্য! মেয়েটা কি তার মনের সব সব কথা বুঝতে পারে?
"-তুমিতো জানো, কি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ড আমার। পাশ করে বেরুতেই ফার্স্ট ক্লাস গ্রেডের চাকরি পেয়ে গেছি। চমৎকার চেহেরাসহ হ্যান্ডসাম বডি। দু’দিন না খেয়ে থাকতে পারি অনায়াসে। ভার্সিটি মেয়েদের ক্রাশ আমি। কত মেয়েদের প্রেমপত্র না পড়েই ফেলে দেই ।” রাত্রির সব কথার উত্তর বকুল এভাবেই মনে মনে শেষ করে। বকুল হাসলো। বোকার মত কি?
রান্না ঘরে রিয়া বসে আছে। তার সামনে সমস্ত বাজার ছড়ানো। রাত্রি বলল – “এভাবে বসে থাকিস না। কিছু একটা কর।”
রিয়া রাত্রির দিকে তাকালো। শীতল গলায় বলল- ”তুই রান্না কর। আমি পারবো না।”
-”আরে তোকে রান্না করতে কে বলেছে? তুই চিৎকার কর, কান্নাকাটি কর, কিছু একটা কর। এইভাবে মূর্তির মতো বসে থাকিস না।”
তারপর খুব নরম করে বলল-”রিয়া, বকুল ভাই খুবই ক্ষুধা নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তার সম্ভবত কাল থেকে খাওয়া হয়নি। তার খুব ভাতের ক্ষুধা পেয়েছে।”
রিয়া অবাক চোখে রাত্রির দিকে তাকিয়ে রইল। রাত্রির কাছে রিয়ার চোখের দৃষ্টিতে অবাক হওয়া প্রশ্ন দেখতে পেয়ে আর দাঁড়ালো না। সে তার রুমে চলে গেল।
আজ রায়ান, ওদের একমাত্র ছোট ভাই, বাজার করে এনেছে। বাজারের ব্যাগে ডিম, মাছ, সবজি, ডাল সব একসাথে একাকার করে এনেছে। এক ডজন ডিম বাজারের ব্যাগের ভিতর ভেঙ্গে যা তা অবস্থা। কাজের ছুটা বুয়াটির যেদিন নিজের ঘরে অশান্তি থাকে সেদিন অযথাই রিয়ার সাথে এটা সেটা নিয়ে ঝগড়া করে কাজ করবে না বলে চলে যায়। পরদিন আবার যথা সময়ে কাজ করতে চলে আসে। আজও তাই হয়েছে। একটা কাজের ছেলে আছে। সে দশটা বাজার আগেই রোজ বইপত্রের ব্যাগ গুছিয়ে প্রশিকার এনএফপি স্কুলে চলে যায়। আজও তাই হয়েছে।
রাত্রিরা তিন বোন- রিয়া, রাত্রি ও রিমা, এক ভাই রায়ান ও বাবাকে নিয়ে তাদের সংসার। বহু বছর আগেই তাদের মা মারা গেছেন। সুখের কোনো অভাব নেই। রিয়া এম. এ. ফাইনাল দিয়ে রেজাল্ডের অপেক্ষায়। রাত্রি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। রিমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী। রায়ান এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে। এই তাদের সংসারের চিত্র। রিয়া ভালবাসে পাশের বাড়ির অসম্ভব হ্যান্ডসাম ও বেকার ছেলে সাঈদকে। আজ বাবা ও দারোয়ান বাসায় নেই বলে রায়ানকে বাজারে পাঠিয়েছিলো। বাজারের এই করুণ হাল দেখে সকাল থেকে থানডার্ড হয়ে বসে আছে রিয়া। বকুল ভাই এসেছে শুনে রিয়া বাজারগুলো সব ব্যাগে ঢুকিয়ে ময়লার বক্সে ফেলো দিলো। ফ্রিজ থেকে মুরগী বের করে ভিজিয়ে রেখে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে ড্রয়িং রুমে এলো। বকুলকে বলল- ”বকুল ভাই, শরবতটা খেয়ে রেস্ট নিন অথবা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিন। এক ঘন্টার মধ্যে আমি খাবার রেডি করে ফেলছি।” বকুল চওড়া একটা হাসি দিয়ে শরবতের গ্লাসটা নিলো। তার মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। এতো সহজ আর স্বাভাবিক ফিল করে সে রিয়ার সামনে যেন মনে হয় রিয়া তার বড়বোন বা মা। রিয়া যখন তাকে যত্ন করে খাওয়ায় তখন তার মা'র কথা মনে পড়ে।
দুপুরে মুরগি বিরিয়ানি খেয়ে চমৎকার একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে চায়ের টেবিলে সবার সাথে কথা বলছে বকুল। রিয়া বলল-”আজ থেকে যান বকুল ভাই।”
-”না, রিয়া আমার একটু কাজ আছে।”
-”তাহলে আবার কবে আসবেন?” রিয়া জিজ্ঞেস করলো।
-”এক্কেবারে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়ে।”
রিমি বলল-”বকুল ভাই বেতন পেয়েও কিন্তু আসতে হবে।”
রিয়া হেসে ফেলল। বলল-”কেন, তোর জন্য মিষ্টি আনতে হবে?”
রিমি আবদারের সুরে বলল- ”বেতন পেয়ে আমাকে অনেক দামী ও বড় একটা কসমেটিক্সের বক্স কিনে দিতে হবে।” রিমির কথায় সবাই হসে ফেললো। শুধু রাত্রি গভীর মনোযোগের সাথে ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নো পড়ছে আর মাঝে মাঝে চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছে।
বকুলের মনে হলো রাত্রি যেন ইচ্ছে করেই তাকে বা তার আনন্দচ্ছোল কথাবার্তাকে ইগনোর করছে। তার মনটা খানিকটা খারাপ হয়ে গেলো। রিমি সেটা খেয়াল করলো। সে হটাৎ করেই উচ্চ স্বরে বলে উঠলো-”রাত্রি আপু তোমার কি চাই বললে না?”
রাত্রি বই থেকে চোখ না সরিয়েই বলল-”সমুদ্রের পানিতে সূর্য কীভাবে ডুবে, দেখতে চাই।” সবাই কেমন হকচকিয়ে গেল। এটা আবার কেমন কথা?
রায়ান বলল-”তুই সময় করে একবার তোর মাথাটা চেক করে নে। আমার মনে হয় তোর মাথার সমস্ত ভেইনগুলো বড্ড বেশি পেঁচিয়ে গেছে। তাই সব সময় পেঁচিয়ে ভাবিস।” বলতে বলতে সে উঠে গেলো। বকুলও বলল-”আমি তাহলে আজ আসি।”
বকুল চলে যাচ্ছে। রাস্তায় এসে তার দেখতে খুব ইচ্ছে হলো বারান্দায় তার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা। না, সে দেখবে না। বারান্দায় কেউ থাকুক আর না-ই থাকুক, তার কি আসে যায়, ভাবলেও মন কোন যুক্তি তর্ক মানে না। মন চলে তার নিজস্ব নিয়মে, ভবলো -তার পিছনের বারান্দায় ছায়াবীথির মেজো মেয়ে রাত্রি দাঁড়িয়ে আছে! বকুলের খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। হোঁচট খাওয়ার ভাণ করে উপুর হয়ে পিছনে আড়চোখে চোখে তাকিয়ে দেখলো কেউ দাঁড়িয়ে নেই বারান্দায়। ভেজা তোয়ালেটা ঝুলছে শুধু।
প্রায় দু’ সপ্তাহ পরে। বকুলের এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটি এসেছে। পোস্টিং হয়েছে রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আজ রাতের ট্রেনে সে রাঙ্গামাটি চলে যাবে। যাওয়ার আগে তার মাথায় কি ভূত চাপলো। সেই ভূত তাকে সাহস দিলো-”ফোন কর বকুল। আজ না পারলে আর কখনোই পারবিনা। ডেকে আন রাত্রিকে। বলে দে তোর সব কথা। বলে দে, তোর রাঙ্গামাটি যেতে ইচ্ছে করছে না ওখানে রাত্রি নেই বলে।”
বকুল সত্যিই রাত্রির মোবাইলে ফোন করলো। রাত্রি এলো। রিকসা থেকে নামতে নামতে দেখলো কবি নজরুলের কবর চত্বরে বকুল দু’হাতের তালু কচলাচ্ছে আর একবার গেটের ভিতরের দিকে ও একবার গেটের কাছে যাওয়া আসা করছে। রাত্রিকে দেখতে পেয়ে বলল-”এতো দেরি করলে কেন?”
-”রাস্তায় খুব জ্যাম ছিলো। কি ব্যাপার, কি হয়েছে? এমন করে ডেকে পাঠালেন?”
-”তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো রাত্রি। তোমাকে বলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছিনা।”
-”বলুন।”
-”রাত্রি আমি একজনকে ভালবাসি। খুব ভালবাসি। জীবন-মরণ সমস্যা টাইপ ভালবাসা। কিন্তু আমি এখনো তাকে বলতে পারছি না। তুমি আমার হয়ে তাকে বলে দিবে, পারবে না?”
-” নিশ্চয়ই পারবো। অবশ্যই পারবো। আপনি বলুন কে সে?”
-”রাত্রি, সে তোমার ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তোমার সাথেই মানে তোমার ক্লাসেই…”
-” তাই! কি নাম তার?”
-”নামটা পরে বলছি। আগে শোন,সে চোখে চশমা পরে, লম্বা ঘন চুল সব সময় একটা বেনী করে রাখে। তোমার মতো হাইট, ফিগার আর মিষ্টি চেহেরা। আর গায়ের রঙও তোমার মতো। আমি তাকে পাগলের মতো ভালবাসি। তার সামনে গেলে আমার সমস্ত পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়। আমার সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায়। সেই জ্ঞান হবার পর থেকে। বলতে পারিনা ভয়ে, যদি সে আমাকে রিফিউজ করে। তুমি কি তাকে বলে দিবে আমার কথাগুলো?”
রাত্রি ঘাড় কাত করে বলল-”হুম, বলে দিবো।” বকুল আবার বলল-”রাত্রি আমার কি আর কিছু বলতে হবে?”
রাত্রি সরাসরি বকুলের দিকে তাকালো। অসম্ভব নরম গলায় বলল-”না, আর কিছু বলতে হবে না। আমি বলে দিবো।” মনে মনে বলল-”গাধা একটা! এতোগুলো কথা বলতে পারলো অথচ সোজা একটা বাক্যই বলতে পারলোনা- রাত্রি তোমাকে আমি ভালবাসি।”
সে ফিক করে হেসে ফেললো। বকুলের হটাৎ করে মনে হলো সবকিছু কত সহজ আর স্বাভাবিক। পৃথিবী জয় যেন এবার থেকে অনেক সহজ।
মন্তব্য করুন: