প্রকাশিত:
২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৮
আবিদের পরনে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। তার দুই হাতে চায়ের কাপ। সে শিমুলের পাশে কাপ দুটো রাখল। তারপর সন্তর্পণে সিঁড়ির উপর এসে বসলো।
পহেলা বৈশাখের আনন্দে আজ সকলেই ব্যস্ত। সকলেই বাইরে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট থৈ থৈ করছে মানুষে। সকলেরই মুখ হাসি হাসি।
এলাকার বেশিরভাগ বাড়িঘর গুলিই ফাঁকা পড়ে আছে।
শিমুল শাড়ির আঁচলে কবার চোখ মুছলো। বেশ রূপবতী মেয়েটা। খুব দুর্ভাগ্যবশত আজ তারা দুজনেই বাসার বাইরে পা রাখতে পারবে না। বাসার বাইরে পা রাখলেই বিপদ। দুজন অসুস্থ লোককে কেউই বাসার বাইরে ছাড়তে চায় না। কাজেই তাদের পরিবারের কেউই আজ বাইরে যায় নি।
আবিদ চায়ের কাপে চুমুক দিল। শিমুল অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, 'তোমার কি মন খারাপ লাগছে? মন খারাপ থাকলে আমাকে বলতে পারো।'
'কি জন্যে মন খারাপ থাকবে?'
'পাল্টা প্রশ্ন করবে না তো!'
আবিদ লক্ষ্য করল শিমুলের চোখ বেয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে।
'একি তুমি কাঁদছো নাকি?'
শিমুলের মাঝেমধ্যে কেঁদে ফেলবার অভ্যাস আছে। যদিও তার বেশিরভাগ কান্নার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
'তোমার রিপোর্টে কি এসেছে?'
আবিদ চায়ে চুমুক দিল। ঠান্ডা এবং শীতল গলায় বলল, 'রিপোর্টের খবর পেয়েছো বুঝি?'
'হ্যাঁ, পেয়েছি। এবং আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে রিপোর্টটা এই মুহূর্তে তোমার পকেটেই আছে, তাই না?'
'হু, তুমি কি রিপোর্টটা দেখতে চাও?'
'চাই।'
'এখনই দেখবে, নাকি একটু পরে দেখবে?'
'এখনই দেখব।—আচ্ছা থাক, রিপোর্ট দেখাতে হবে না। রিপোর্টে কি এসেছে সেটা বললেই হবে।'
আবিদ খানিক গলা খাকানি দিয়ে বলল, 'লিউকোমিয়া। স্টেজ-০৩ ক্যান্সার।'
শিমুল আগে থেকেই মুখ ভোঁতা করেছিল। এখন সে প্রায় চুপসে গেছে। কপালের উপর বিচিত্র এক ভাঁজ পড়েছে। মুখ ভেঁচকি দিয়ে সে বলল, 'তুমি বুঝি এতে খুব খুশি হয়েছো?'
'কি আশ্চর্য! এতে খুশি অখুশির কি আছে?'
শিমুল আবারো চোখ মুছল। টিস্যু দিয়ে নাক ঝেড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা বেশ ভালো হয়েছে। আবিদ মাঝেমধ্যে শিমুলের জন্য চা বানায়। সুধু যে চাই বানায় তা নয়, মাঝেমধ্যে এমন সব কাজ করে যাতে সে চমকে উঠে।
মানুষকে চমকানোর সে এক বিরাট ইতিহাস। সেই সব বৃত্তান্ত শিমুল একটা লিস্ট করে রেখেছে। তার বুক সেলফের তিন নম্বর তাকে সেটা রাখা আছে।
এই ক' দিনে অবশ্য বিচিত্র ইতিহাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ তার নতুন করে কোন লিস্ট এখনও তৈরি করা হয়নি।
শিমুলকে বেশিরভাগ সময় বিছানাতে থাকতে হয়। ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য বিছানায় শুতে হবে কেন শিমুল তা জানে না।
তার কারণেই বোধয় ডাক্তারদের নাম শুনলেই তার বিরক্তি মাখা চেহারা আরও সচকিত হয়ে ওঠে।
তখন আবিদ মাঝেমধ্যেই তাকে অবাক হয়ে বলে, 'শিমুল, আজ বুঝি বুধবার?'
বুধবার শিমুলের জন্য বেশ আনলাকি ডে। পৃথিবীর সব ভয়ংকর ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ গুলি সে পায় বুধবার রাতে। তার ব্রেস্ট ক্যান্সারের কথাও সে জানতে পারে বুধবার রাতে। আবিদের ব্যাপারটাও ঘুরে ফিরে সেই অভিশপ্ত দিনেই শুনতে হলো।
আবিদ প্রশ্ন করল, 'তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে?'
'না।'
'বেশি খারাপ লাগলে আজ উঠে যায়, অন্য একদিন চা খাওয়া যাবে।'
'কোন সমস্যা নেই।'
'তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?'
'না, রাগ করবো কেন?'
'যাক শুনে ভালো লাগলো।'
'এখানে ভালো লাগার কি হলো! তুমি আমার আগে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছ—এটা কি ভালো কথা!'
'হায়াত মউত আল্লাহ পাকের হাতে। এতে তুমি আমি বললে তো হবে না। যেটা সত্যি সেটা মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যাক সেসব কথা। আজকের আকাশটা খুব সুন্দর তাই না? কি সুন্দর চাঁদ উঠছে দেখেছো।'
শিমুল জবাব দিল না। শান্ত দৃষ্টিতে কেবল উপরের দিকে তাকালো। আবিদ বলল, 'পৃথিবীটা কি অসম্ভব সুন্দর তাই না?'
'আমি তো আর মহাকাশযানে করে পৃথিবী দেখিনি, কাজে বলতে পারছিনা পৃথিবীর সুন্দর না কুৎসিত।'
আবিদ বলল, 'জানো শিমুল, পৃথিবী যতই সুন্দর হোক না কেন, মানুষ ছাড়া এই সৌন্দর্য অর্থহীন। আমরা সৌন্দর্য বলতে কেবলমাত্র প্রকৃতিকে বুঝি, অথচ পরস্পরের সাথে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর সময়টুকুই যে শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য এটা আমরা কেউ বুঝিনা। আচ্ছা মানুষের সঙ্গের প্রসঙ্গ বাদ দেই। প্রকৃতি তার রূপের মাধুর্য চিরকালই ছড়াবে। মানুষ থাকুক কি না থাকুক এতে তার বিশেষ যায় আসেনা। সে তার রূপ প্রদর্শন করবেই। অথচ সে এটা জানেনা—তার রূপচর্চা মানুষ ছাড়া মূল্যহীন। তার কারণ মানুষই রূপের আসল মর্যাদা দিতে জানে। গরু ছাগলে তা জানে না। গরু ছাগল তো আর মুখ ফুটে "অপূর্ব" কথাটি বলবে না। কে জানে, একদিন হয়তো পৃথিবী থেকে সমস্ত মানুষ হাড়িয়ে যাবে। তার ফেলে যাও সভ্যতারাও হারিয়ে যাবে। নিঃসঙ্গ প্রকৃতি একাকী মনে কাঁদবে। এমনটা হওয়াটা কি সম্ভব নয়?'
'হু।'
'কি হু হু করছো! আমি একটা প্রশ্ন করেছি তার জবাব তো দাও!'
'হু।'
শিমুল অনেক চেষ্টার পরও ' হু ' ছাড়া আর কোন শব্দ বের করতে পারল না। তার মুখে কোন বাক্য নেই। আবিদ তার দিকে ড্যাব ড্যাবে চোখ করে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বেশ মায়া লাগছে।
মুখটা সরাতেই শিমুলের একরাশ কান্না পেয়ে গেল। অঝোর ধারার কান্না যাকে বলে।
সে খুব করে চেষ্টা করছে না কাঁদতে। কিন্তু পারছেনা। এই মানুষটাকে সে হাড়াতে চায় না। কিছুতেই না। খুব ছোট থেকে দুজন একসাথে আছে। মায়া নামক শব্দটি থেকে কোন এক পর্যায়ে ভালোবাসা জন্মে গেছে। এক বেদনাদায়ক অনুভূতি।
শিমুল হঠাৎই চায়ের কাপ রেখে আবিদের গা ঘেসে বসলো। মমতা নামক ক্লান্ত হাত দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কি সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে শিমুলের চুল নড়ে নড়ে উঠছে। অথচ তার কান্নার দৃশ্য কি অসাধারনই না লাগছে এ রাতে।
মন্তব্য করুন: