একটু আগেই বিকেল ছিলো। সন্ধ্যের নিস্তব্ধ বিদায় দেখছিলাম আমরা তিনজন মাঠের এক কোণায়। সূর্য এক দুই তিন করে হেলেদুলে ডুবে যাচ্ছিলো চোখের সামনেই। বিভ্রান্ত পথিকের মত উস্ক-শুষ্ক চুলে কোত্থেকে এসে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে শাহরিয়ার পা দুলিয়ে বসেছিল আমার ঠিক সম্মুখে। নাজমুল স্কুলের শিক্ষকদের কথা বলছিল, হেডটিচারের সাথে আজকাল আর মিলে না। স্কুল চেঞ্জ করতে চাচ্ছে। অ্যাসেম্বলি শেষে তর্ক-বিতর্ক করতে করতে নাজমুল হঠাৎ উত্ত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল, নাজমুল বরাবরই এক কথার মানুষ। ছোটবেলা থেকেই একসাথে খেলেছি, একসাথে থেকেছি, একসাথে পড়েছি । ওর সম্পর্কে বন্ধুদের মাঝে আমি সবচেয়ে বেশি জানি। অন্তত অন্যদের চেয়ে ওকে চেনার সুযোগ আমার একটু হলেও বেশি হয়েছে। "হাকিম নড়ে হুকুম নড়ে না" এমন অবস্থা তার। একটু জেদী, উষ্ণস্বভাবের কিন্তু সে বিদ্বেষপরায়ণ অথবা হিংসাপরায়ণ নয়। কোন প্রকার কোন্দলে সে সহজে জড়াতে চায় না, মাঝে মাঝে তাকে বদমেজাজি হতেও দেখা যায়।
ডান পাশে একটি বড়ই গাছ। গাছের কিছু পাতা সবুজ, উগ্র রকমের সবুজ, এই পাতার কিশোরকাল চলছে আর কিছু পাতায় হলুদ বর্ণ ধরেছে বলা যেতে পারে এগুলো প্রৌড়ের ধারপ্রান্তে । অধিকাংশ পাতা পোকা খাওয়া- সহস্র ছিদ্রে জর্জরিত। পাশে ধূলা উড়িয়ে একদল খেলছে। আকাশের রঙ হালকা নীল, প্রজাপতি উড়ে গেলো সামনে দিয়ে, পশ্চিমের লাল সূর্যের অন্তিম বার্তা দিচ্ছে। অনেক কথা হচ্ছে, তারপরেও কথার অন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিরতিহীন, অনবরত, ক্রমাগত, একটানা। অনেকটা লাগাম ছাড়া কথা, একজনের কথা বলা শেষ হতে না হতেই আরেকজনের কথা শুরু হয়ে দিচ্ছে, আড্ডা মধুর রকমভাবে জমে উঠেছে। একজন পেটিস বিক্রি করতে এসে তিনজনের হাতে তিনটা ধরিয়ে দিল, ৪৫ টাকা দাম দিলাম। হাতে করে চা বিক্রি করছেন সাদা গেঞ্জি গায়ে দেওয়া লোকটি। নাজমুল জিজ্ঞেস করল- চা খাবি? আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে বললাম- মামা লাল চা হবে? আদা আর লেবুর রস দিয়ে তিনটা দেন ।
গত শুক্রবার কোন পত্রিকায় কার লেখা আসলো সে বিষয়ে কথা বললাম। নাজমুল বললো- আজকাল আর লিখতে ইচ্ছে করে না, একঘেঁয়েমি চলে এসেছে তা নয়। কেন জানি মন থেকে লেখার শক্তি পাচ্ছি না। খাতা-কলম নিয়ে টেবিলে বসে থাকি, কলমের আগা দিয়ে কিচ্ছু আসে না।
বইমেলায় শাহরিয়ারের "বুলেট নাজিম" নামে একটা থ্রিলার এসেছে। আমি গত সপ্তায় স্থানীয় দুইটা পত্রিকায় "বুলেট নাজিম" নিয়ে রিভিউ লিখেছি। কাগজের দাম বেড়েছে, মুদ্রণের দাম বেড়েছে , বাঁধাইয়ের দাম বেড়েছে, সবকিছু মিলিয়ে বইয়ের দাম বেড়েছে কিন্তু বইমেলায় পাঠকের বই কেনার সংখ্যা কমেছে। আমাদের দেশে আমরা যতই উচ্চবিত্ত সৌখিন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা বলি না কেন মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন-ই বই কিনেন এবং পড়েন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের লোকজনের হাতে টাকা নেই, তারা মেলায় এসে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক বই কিনতে পারছেন না। এই বিষয়ে আমরা তিনজন কতক্ষণ প্রলাপ বকলাম। গল্পচ্ছলে কথার মোড় ঘুরে যাচ্ছে বারবার, ঝর্নার মতো ধারা নামে আবার নদীর স্রোতের মতো তলিয়ে যায়। কথাগুলো বড্ড বাধ্য আবার চিরকাল চমৎকার অবাধ্য। শাহরিয়ার আগে যুতসই ও ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখিত। পৃথিবীর মানচিত্রের উপর পর্যাপ্ত, প্রচুর ও যথেষ্ট কনসেপ্ট আছে । বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদের ইতিহাস তার কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মুখস্ত এবং ঠোঁটস্থ। বন্ধু সার্কেলে তাকে অনেকে ইতিহাসের বই নামেও ডাকে।
সূর্য খানিক আগে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, এখানে জোনাকি নেই মাঠ জুড়ে ধুলাবালি, এখানে প্রকৃতির প্রাকৃতিক নীরবতাকে হত্যা করেছে গাড়ির বিশ্রী রকমের সাইরেন। আলোর প্রচন্ড ঝলকানি আছে কিন্তু মুগ্ধতা নেই।
নাজমুল উঠে দাঁড়ালো। কি রে চলে যাবি নাকি? আমি শাহরিয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, নাজমুল হাতের ভাঁজ খুলতে থাকলো। পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, লেখালেখি সমস্ত আড্ডার এইখানে ইস্তফা। চল্ তবে সামনের দিকে, যেখানে রাস্তা গুলো অজগর সাপের মত এঁকেবেঁকে যাচ্ছে- জটলা জটলা গাড়ি থেমে থেমে আছে, ট্রাফিক জ্যাম। লেগুনাগুলো এতো জোরে ছুটে স্পিড ব্রেকার পর্যন্ত মানে না। মাঝে মাঝে খুব বাজেরকম ও অসন্তোষে এগুলোতে চেপে বসতে হয়। বিরক্তিকর- এমন ঝাঁকুনি দেয় মনে হয় মাথা গাড়ির ছাদ স্পর্শ করবে।
আমি রিকশা চেপে বাসায় পৌঁছাব এমন সময় শাহরিয়ার কল দিয়ে জানালো এক্সিডেন্ট হয়েছে, তাড়াতাড়ি মেডিকেলে আয়, কোন মেডিকেল জিজ্ঞেস করার আগেই ফোন কেটে গেল। আমি কল ব্যাক করার চেষ্টা করছি, বারবার ট্রাই করছি কিন্তু সংযোগ পাচ্ছিনা। বললাম- রিক্সা ঘুরাও মামা। তিনি বললেন- কোন দিকে যাবেন? বললাম, মেডিকেলে। কোন মেডিকেল জিজ্ঞেস করতে আমি আর কথা বলতে পারলাম না। সামনের দিকে চলতে থাকেন, আমি একটু কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। আমি আবারও ট্রাই করছি। ভাবলাম নাজমুলকে একটা কল দেই, রিং হয়ে যাচ্ছে ফোন তুলছে না। উফ্!
ডাটা অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেখলাম- চট্টগ্রাম মেডিকেল, ইমারজেন্সি। অত্যন্ত ব্যস্ত এবং হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম মেডিকেলের দিকে, প্রবর্তক মোড়ে এক জটলা ট্রাফিক জ্যাম পেলাম। ইমারজেন্সিতে যাওয়ার আগে শাহরিয়ার আবার কল দিলো, ব্লাড লাগবে, তাড়াতাড়ি ম্যানেজ কর। ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই বুঝতে পারেনি- তবে আঁচ করতে পারলাম একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।
ব্লাড ম্যানেজ হলো, অপারেশন হবে। আপাতত তিন ব্যাক স্টকে আছে, বন্ধুবান্ধবদের খবর দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনে আরো ব্লাড পাওয়া যাবে। ব্লাড নিয়ে টেনশন নেই। অপারেশন নিয়ে টেনশনে আছি। ভালো-মন্দ কিছু বুঝা যাচ্ছেনা, ইমারজেন্সি থেকে বলা হচ্ছে- নাজমুলের পা কাটতে হবে। সন্ধ্যা গলে গেছে। রাত গভীর হতে চললো। শাহরিয়ার চুপচাপ আমার পিছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে। এই দস্যুপনা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। কী দরকার ছিল রাস্তায় লেগুনা এত জোরে চালানোর? লেগুনার ড্রাইভারগুলো বকাটে,অশিক্ষিত, বর্বর, অসভ্য, বন্য।
মন্তব্য করুন: