বুধবার, ২২শে জানুয়ারী ২০২৫, ৯ই মাঘ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • বিদেশি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর
  • থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ
  • ফ্লাইটে বোমা হামলার হুমকি, শাহজালালে সতর্কতা জারি
  • ৭ দিনের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনের সব মামলা প্রত্যাহার হবে
  • চার অতিরিক্ত ডিআইজিসহ পুলিশের ২০ কর্মকর্তাকে বদলি
  • আগামী বাজেটে ভ্যাট সমন্বয় করা হবে
  • এনআইডির জরুরি সেবা অব্যাহত রাখতে ইসির নির্দেশনা
  • আজও ঢাকার বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’
  • মার্চের মধ্যে বদল হচ্ছে ২৬ জেলার ডিসি
  • অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত যুক্তরাষ্ট্রের

জামালপুর টাউন জংশন স্টেশন

খোলা আকাশের নিচে রাখা হয় ট্রেনে কাটা মরদেহ

নিপুন জাকারিয়া, জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত:
২০ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭:৪৫

ব্রিটিশ সরকারের হাতে গড়া জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিগত প্রায় দেড় শতাব্দীতে নানামূখী উন্নয়ন হলেও রেলওয়ে স্টেশনটি জরাজীর্ণ, নেই কোন লাশঘর। মরদেহ রাখার জন্য বাঁশ আর টিনের তৈরি একটি ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করা হলেও তা পরিত্যক্ত আগাছা আর লতাপাতায় ছেয়ে গেছে দীর্ঘদিন দিনের অব্যবহৃত ঘরটি । রেলওয়ে জংশন স্টেশন এলাকায় ট্রেনে কাটা মরদেহ নিথর দেহটি, শক্ত পলিথিন বা চট দিয়ে মুড়িয়েই ফেলে রাখা হয় রেলওয়ে জি আর পি থানার সামনে প্লাটফর্মে।

জামালপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জংশন রেলওয়ে স্টেশন। দেশের পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের আওতাধীন এ স্টেশন চালু হয় ১৮৯৪ সালের ৩ নভেম্বর।স্টেশনটি চালুর পর থেকে ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড। স্টেশনে রয়েছে পার্সেল অফিস,বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা, প্রতিবন্ধীদের প্রবেশাধিকার, পার্কিং, যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার, প্রতিবন্ধীদের ট্রেনে ওঠা নামার জন্য হুইল চেয়ার, ফুট ওভারব্রিজসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে মরদেহ রাখার ব্যবস্থা নেই, পড়ে থাকে খোলা আকাশের নিচে। পরিবারের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ না থাকলে মরদেহ দ্রুত হস্তান্তর করা হয় আর যদি মৃত্যু রহস্যজনক হয় কিংবা পরিচয় সনাক্ত করতে বিলম্ব হয়, তবে ঘন্টার পর ঘন্টা চট বা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় মরদেহ পড়ে থাকে খোলা আকাশের নিচে। অনেক সময় লাশ থেকে টুপ টুপ করে রক্ত ঝরে পড়ে প্লাটফর্মে যা দেখে প্লাটফর্মে আগত যাত্রীরা ভয় পেয়ে যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা মরদেহ ভিজে, এসব যেন দেখার কেউ নেই। লাশের সাথে যেসব আলামত পাওয়া যায় তা সংরক্ষণ করা হয় জি আর পি থানাতে। থানার পাশেই টিন, বাঁশ দিয়ে বানানো যে লাশ ঘরটি রয়েছে বর্তমানে সেই ঘর আগাছা আর লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। জরাজীর্ণ লাশ ঘরটি ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে রেলের ডোম কাদের মিয়া ও তার সহযোগী খায়ের মিয়া সন্তুষ্ট নন কারণ লাশ রাখা নেই নিদিষ্ট স্থান নেই আলামত সংরক্ষণের ব্যবস্থা। নেই কোন মাসিক বেতন শুধু ট্রেন দূর্ঘটনার কেউ মারা গেলে ১২'শ টাকা পেয়ে থাকে যা দিয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা দুষ্কর হয়ে যায়।

স্থানীয়রা জানান, ২০০৭ সালের দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর অফিস সংলগ্ন লোহার গ্রিলের সাথে বাঁশ এবং রশি দিয়ে বেঁধে ট্রেনে কাটা লাশ ঝুলিয়ে রাখা হতো। সেই লোহার গ্রিলের নিচেই ছিল যাত্রীদের বসার স্থান। অনেক সময় ট্রেনের যাত্রীরা ঠিক ঝুলন্ত বস্তাবন্দি লাশের নিচে গিয়েই বসে পড়তেন। যাত্রী যখন বুঝতে পারতেন তারা যে স্থানে বসে আছেন তার মাথার ওপরে লাশ সে সময় অনেক যাত্রীই আতঙ্কিত হয়ে পড়তো।

স্থানীয়রা আরও জানান, ব্রিটিশ সরকারের হাতে গড়া পুরাতন জংশন স্টেশনটি ভেঙে আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হলেও ট্রেনে কাটা মরদেহ রাখার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ।

সাহাপুর এলাকার বাসিন্দা জামালপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের কোষাধ্যক্ষ ফয়সাল মাহমুদ জানান, কিছু দিন আগে কলেজ পড়ুয়া প্রিয়া নামের এক তরুণী তার বাবা মায়ের সাথে সকালের ব্রহ্মপুত্র ট্রেনে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেলওয়ে জি আর পি থানার সামনে অপেক্ষা করতে থাকে, ট্রেন আসতে বিলম্ব হওয়ায় প্রিয়া থানার সামনে রাখা ভ্যান গাড়িতে একটু হেলান দেয়। কিছুক্ষণ পর প্রিয়া আচমকা পিছেনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সে যে ভ্যানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভ্যানের উপর রয়েছে ট্রেনে কাটা লাশ। মুহুর্তেই সে ভয় পেয়ে তার বাবা মা কে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। তিনি আরো বলেন, বর্ষাকালেও লাশ খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়, আর সেই লাশ ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টির পানিতে ভিজে যা খুব দুঃখজনক।

শহরের কাচারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রহুল আমিন মিলন দৈনিক নাগরিক সংবাদকে জানান, একটি লাশ ঘর হওয়া খুব জরুরি। বিগত ফ্যাসিক সরকার প্রয়োজনীয় এমন একটি লাশ ঘর নির্মান না করে, লুটপাটে ব্যাস্থ ছিল। একই সাথে তিনি , যে দুজন ডোম বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন, তাদের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ থেকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। কেননা তারা যদি এই কাজ বাদ দেয় তাহলে লাশ টানার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় রক্ত ঝরে পড়ে প্লাটফর্মে যা দেখে প্লাটফর্মে আগত যাত্রীদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে, এই ঘর নির্মানের জোর দাবী রাখেন।

জামালপুর রেলওয়ের ডোম কাদের মিয়া বলেন, ময়মনসিংহ রোড স্টেশন থেকে জামালপুর পর্যন্ত এবং জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ রেল স্টেশন এবং ভুয়াপুর স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে কেটে কেউ মারা গেলে আমি আর আমার সহযোগী খায়ের মিয়া ছুটে যাই ঘটনাস্থলে কিন্তু প্রতিটি লাশের জন্য আমাদেরকে দেয়া হয় মাত্র ১২'শ টাকা। তিনি আরও বলেন, ময়মনসিংহ রোড, তারাকান্দি কিংবা বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন থেকে একটা লাশ বহন করে আনতে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়। খরচের তুলনায় এতো অল্প টাকা দিলে আমাদের সংসার কি করে চলে। তিনি বলেন, এই ১২'শ টাকা নেওয়ার জন্য আমাদের দুই থেকে তিন দিন স্টেশন মাষ্টারের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, তারপর এই টাকা পাওয়া যায়। কাজের চাপ নিয়ে আমাদের কোন অভিযোগ নেই কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক না পেলে আমাদের পরিবার কি ভাবে চলবে।

জামালপুর জেলা নাগরিক ভয়েস এর সভাপতি কাফি পারভেজ বলেন, এটা রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। রেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে অনেক আগেই এই সমস্যার সমাধান করতে পারতো কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন এই সমস্যার সমাধান হয় সংশ্লিষরট কর্তৃপক্ষের নিকট আহবান জানিয়েছেন ।

জামালপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার দেওয়ান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমি অল্প কিছুদিন আগে যোগদান করেছি। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি রেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।

জামালপুর রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জুয়েল খান বলেন, এটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোন কাজ না এটা জি আর পি পুলিশের কাজ তাদের বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কাজ তারাই করে থাকে।

জামালপুর রেলওয়ের সিনিয়র সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর ইসলাম বলেন, এসব কাজ রেলওয়ে জি আর পি থানার মাধ্যমেই হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে তারা এই কাজ গুলো করতে পারে।

ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন দৈনিক নাগরিক সংবাদকে জানান, এটা আমাদেরও চাওয়া যেন একটি লাশ ঘর হয়। অনেক সময় মৃতদেহ বৃষ্টিতে ভিজে একটি লাশ ঘর হলে মৃতদেহ নিরাপদে থাকবে পুলিশের কাজ করা সহজ হবে।

লাশের প্রতি সম্মান জানানো উচিত আমাদের সবার।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর