প্রকাশিত:
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩১
চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এই অভ্যুত্থান স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলে। সারাদেশের মানুষ শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য নয়, একটি মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তার জন্য গণ-অভ্যুত্থানে নেমেছিল। এ আন্দোলনের আকাক্সক্ষা ধারণ করে জনগণ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সম্মতি জানায়।
গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচার অবসান, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত সুশাসিত রাষ্ট্র নির্মাণ। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ও রাজনীতির কাঠামোগত সংস্কারে এগিয়ে আসে। সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমনসহ মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে ৪টি কমিশন ইতোমধ্যে তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলো মূলত একটি প্রস্তাবিত রূপরেখা বা নীতিমালা, যা সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এসব প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছে। যে বিষয়ে সর্বসম্মত ঐক্য গড়ে উঠবে, সেসব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে; বাকি কাজ নির্বাচিত সরকার সম্পন্ন করবে।
১৯ এপ্রিল ২০২৫, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোত্তম নির্বাচন, যা গণতন্ত্রের যাত্রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ একটি বৈষম্য, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও সহিংসতামুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল। এই প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেয়। যদিও শুরুতে জনগণ তাদের স্বাগত জানায়, দ্রুতই অসংযত আচরণ, উগ্রতা এবং মব রাজনীতির প্রবণতায় এনসিপির প্রতি সমর্থন কমে যায়।
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে দলটির প্রস্তাবিত ধারণাগুলো যেমন ‘বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান চালু, ‘রিসেট বাটন’, ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘১৬ বছরে ভোটাধিকার’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাধারণ জনগণের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি। ফলে এনসিপি একটি ‘এলিটিস্ট ন্যারেটিভ’ তৈরি করে, যেখানে জনতার ভাষা, অনুভূতি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অনুপস্থিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় ইতিহাস নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতি হুমকির অভিযোগ এবং ভাষার ঔদ্ধত্য এনসিপির জনপ্রিয়তা আরও ক্ষুণ্ন করে। যদিও নাগরিকতন্ত্র একটি সম্ভাবনাময় ধারণা ছিল, মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকে এনসিপি বিবৃতি ও ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ থাকায় তারা জনগণের সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।
ভোটাধিকার, জীবিকা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যখন জনগণ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছিল, এনসিপি তখন সাধারণ নীতিকথায় সীমাবদ্ধ ছিল। অভ্যন্তরীণ আর্থিক দুর্নীতি ও গরিব মানুষের জন্য কার্যকর কর্মসূচির অভাবও তাদের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এনসিপির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে না পারা। জোট রাজনীতির বাস্তবতায় সমন্বয় ও সংলাপের পরিবর্তে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এককভাবে এগোনোর চেষ্টা করে এনসিপি মূলধারার আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে প্রান্তিক হয়ে যায়।
অন্যদিকে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যখন দেশে অস্থিরতা, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ বিরাজ করছিল, তখন বিএনপি দায়িত্বশীলতা, সংযম এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়েছে। তারা জনগণের আন্দোলনের শক্তি ও আকাক্সক্ষাকে মূল্যায়ন করে এমন কৌশল গ্রহণ করেছে, যা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়েছে।
বিএনপি উপলব্ধি করেছে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা কোনো তাৎক্ষণিক আবেগ নয়, বরং এটি ধৈর্য, সংলাপ এবং ধারাবাহিক দূরদর্শিতার ফল। তারা জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের অবস্থানকে নির্বিচারে সামঞ্জস্য করে চলেছে। বিএনপির কৌশলী ধৈর্য, গণ-আন্দোলনের প্রতি অবিচলতা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য অঙ্গীকার তাদের জনগণের মাঝে এক শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ভবিষ্যতের জন্যও একটি সুদৃঢ় আশার ভিত্তি নির্মাণ করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি স্পষ্ট অবস্থান দেখা যাচ্ছে একটি পক্ষ দ্রুত নির্বাচন চায়, অপর পক্ষ মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন চায়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সতর্ক করেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে সংকট আরও গভীর হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে, যদিও এখনও নির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়নি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও নিশ্চিত করেছেন, নির্বাচন জুনের পরে যাবে না।
গণহত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই আইনের শাসন মেনে, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া উচিত। তাড়াহুড়ো করে বিচার প্রক্রিয়া চালালে তা দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধের বিচার ধৈর্য, সতর্কতা ও নিরপেক্ষতার দাবি করে, যাতে আইনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও দেশের সম্মান বজায় থাকে। কিন্তু এনসিপি বিচার প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অথচ এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ বছর সময় প্রয়োজন। তা হলে জাতীয় নির্বাচন আসলে কবে অনুষ্ঠিত হবে?
এনসিপির ভেতরের নৈতিক দ্বন্দ্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে সংকুচিত করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি একরামুজ্জামানের সঙ্গে নাহিদ ইসলামের বৈঠক, মুরাদনগরে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের সাবেকদের সক্রিয়তা এনসিপির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এনসিপির কার্যক্রম ঘিরে আওয়ামী লীগের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এটি একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রশ্ন জাগে, এনসিপির মৌলিক সংস্কার নামে জাতীয় নির্বাচন বিলম্ব করার উদ্দেশ্য কী? এনসিপি তথা নাহিদ ইসলামের সংস্কারের বুলিগুলো কি আসলে আওয়ামী লীগের নির্বাচন ঠেকানোর এজেন্ডার অংশ, নাকি পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসনের একটি প্রকল্প?
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। আজ এনসিপি নতুন সম্ভাবনার প্রতীক নয় বরং এক অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও ভঙ্গুর স্বপ্নের স্মারক। নেতৃত্বের ভাষাগত বিচ্যুতি, সংগঠনের দুর্বলতা, শিক্ষাক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ এবং মব তৈরির অভিযোগ তাদের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করেছে। তৃণমূল বিচ্ছিন্নতা, সংগ্রামী চেতনার অভাব এবং শহুরে কল্পনানির্ভর রাজনীতির ফলে এনসিপি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। বৈশাখী আয়োজনে জনশূন্য ছিল জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের প্রতিফলন। আন্দোলন ও সংগ্রাম ছাড়া কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠে না এ বাস্তবতা এনসিপি উপলব্ধি করতে পারেনি।
তবে, অনেকেই এখন এনসিপির মধ্যে পরিচ্ছন্ন ও জাতীয় স্বার্থনির্ভর নেতৃত্বের সম্ভাবনা দেখেন। সঠিক সিদ্ধান্ত, সংগঠন পুনর্গঠন এবং জনগণের দাবিকে ধারণ করতে পারলে এনসিপির সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে সেই প্রত্যাশাই থাকল।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়, যাতে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ সুস্পষ্ট হয় এবং স্বৈরাচার উচ্ছেদের ঐতিহাসিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা একটি সময়োপযোগী ও অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন, যা জনগণের মতামত ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নয়; এটি গণমানুষের স্বপ্ন, প্রত্যাশা এবং অধিকার পুনরুদ্ধারের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রতি গণতন্ত্রের দায়বদ্ধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিত দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুতÑ এখন প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ। নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই; নির্বাচন এখন সময়ের দাবিতে একান্ত জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
মন্তব্য করুন: