প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:২৫
ভারতে কমেছে চিনির দাম। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে চোরাকারবারিরা। প্রতিদিনই নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে চিনি আসছে দেশে।এতে করে চোরাকারবারি, মধ্যসত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও সরকার হারাচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলমাকান্দা উপজেলার ফুলবাড়ি বাজার, লেঙ্গুড়া বাজার, বটতলা, বলমাঠ, গোপালবাড়ি, চেংনী, কাঠালবাড়ি, বউ বাজার,নলছাপড়া বাজার ও গোবিন্দপুর বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে আসছে ভারতীয়চিনি। আর যাচ্ছে বাংলাদেশী মাছ ও সুপারী। বাজারগুলোতে ভারতীয় চিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশী তীর চিনি, দেশ বন্ধু চিনি ও ঈগলু চিনির
নতুন বস্তায় ভরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অবৈধ পথে আসা এসব ভারতীয় চিনি হয়ে যাচ্ছে তীর, দেশ বন্ধু ও ঈগলু ব্র্যান্ডের চিনি। অবৈধ পথে আসা এসব ভারতীয় চিনি বাংলাদেশী তীর চিনি ও ঈগলু চিনির নতুন বস্তায় ভরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করছে পিকাপ ও ট্রাক। সবুজ সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে চিনির বস্তা গাড়িতে
তুলে বিশেষ মহলকে ম্যানেজ করেই এসব চিনি বাজারজাত করা হচ্ছে।
ফুলবাড়ি বাজারের সামনে দেখা মেলে টিলার পাশ দিয়ে মেঠো পথ ধরে ভারতীয় সীমান্ত হতে দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে মোটর সাইকেল বহর। প্রতিটি মোটর সাইকেলেই দুই বস্তা করে চিনি পরিবহণ করা হচ্ছে। এছাড়াও সাইকেলে পরিবহণ করা হচ্ছে এক বস্তা। এদৃশ্য পুরো সীমান্ত এলাকায় সকাল-দুপুর ও সন্ধ্যায়। এই মেঠো পথ ধরে একটু সামনে গিলেই চোখে পড়ে একদল শ্রমিক ভারতীয় সীমান্ত হতে মাথায় করে চিনির বস্তা এনে অপেক্ষমান মোটর সাইকেলে পৌছে দিচ্ছে, মোটর সাইকেল চালক দ্রুত গতিতে সীমান্তের নিকটবর্তী বাজারে পরিবহণ করছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল চিনি চোরাচালানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন বাঁধা-নিষেধ নাই। তবে সুপারীর বস্তা দেখলেই তারা ধরে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে কিছু চিনিও ধরে।
খারনৈ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মিনিট দশেক মেঠো পথ ধরে হাঁটলেই দেখা মেলে ভারতীয় সীমান্তে কানাই বাজার। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর দেখা মিললো ভারতীয় সীমান্ত থেকে বয়ে আসা একটি ছড়্ধাসঢ়;। ছড়ার উপর সুন্দর একটা কালভার্ট, সেখানে বসে কিংফিসার স্টং লেখা, নিচে মাছরাঙ্গা ছবি লগো সম্বলিত বোতলে ভারতীয় মদ পানে ব্যস্ত কিছু তরুন। এই পথ ধরেই দলে দলে যুবক শরনার্থীর মতো ছুটছে ভারতীয় সীমান্তের কানাই বাজারে। একটু পরেই মাথায় করে নিয়ে আসছে ভারতীয় চিনির বস্তা। ছড়ার পাশে রেখে যাওয়া সাইকেলে চিনির বস্তা বেঁধে দ্রুত গতিতে ছুটছে গোবিন্দপুর বাজারে। দেখা মেলে চোরাকারবারির কাজে নিয়োজিত পিতা-পুত্রের সাথে। পিতা মোহাম্মদ আলী (৪৫) ও পুত্র দশম শ্রেণির ছাত্র ওমর ফারুক গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা। তারা জানান, গোবিন্দপুর গ্রামের পরিমল মাছের ব্যবসা করে। প্রতিদিন সকালে এই পথ ধরে পরিমল দেশীয় মাছ নিয়ে যায় কানাই বাজারে। এছাড়াও এই পথে নিয়োমিত সুপারি ভারতে পাচার হয়। সন্ধ্যা নামলেই শত-শত চোরাকারবারির লাইটের আলোই জোঁনাকী পোকার মতো আলোকিত হয়। সে দৃশ্য সত্যিই উপভোগ করার মতো। মোহাম্মদ আলী বলেন, এলাকায় কোন মিল-কারখানা না থাকায় আমরা কর্মহীন বেকার। সংসার চালানোর জন্য উপার্জনের একটিমাত্র পথ চোরাকারবারি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিনি ব্যবসায়ীরা জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল অবৈধ চিনি ব্যবসার সাথে জড়িত। এলাকার শিশু-কিশোর ও নিরীহ সাধারণ লোকদের তারা চিনি আনার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। সীমান্ত অতিক্রম করেই তারা ভারতীয় বস্তা পরিবর্তন করে দেশীয় বস্তায় চিনি পরিবহণ করছে। ফলে প্রশাসন ইচ্ছা করলেও কিছু করতে পারছে না। সবকিছু ম্যানেজ করেই চিনির গাড়ি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করছে কিছু কথিত সাংবাদিক। তাদেরকে প্রতি গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন দপ্তরের নির্ধারিত লোক নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করে, তাদের নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করেই নিয়োমিত চলছে অবৈধ পথে আসা ভারতীয় চিনির ব্যবসা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝে মাঝে কিছু চিনি জব্দ করলেও সুকৌশলে আবার বেরিয়ে আসছে সেসব চিনি।
জানা যায়, গত ৩১ জুলাই বারহাট্টা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬৫ বস্তা ভারতীয় চিনি ও চিনি পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত দুইটি পিক আপ গাড়ি জব্দ করেন। জব্দকৃত চিনি সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর তীর এবং মোনো সুগার রিফাইনারী লেখা ইগলু ছাপাযুক্ত প্লাস্টিকের বস্তায় পরিবহণ করা হচ্ছিল। চিনি চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকায় কেন্দুয়া উপজেলার কালিয়ান গ্রামের আক্তার আলী ওরফে খোকন মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন ও ময়মনসিংহ জেলার ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুুর গ্রামের আবুল হাশেম সরকারের ছেলে হিমেল সরকারকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার আঠারোবাড়ির ওয়াসীমের সাথে যোগাযোগ করে কলমাকান্দা থানার ভারতীয় সীমান্ত এলাকা হতে ভারতীয় চিনি চোরাচালানের মাধ্যমে নেত্রকোণাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করে বলে স্বীকার করেন। ওয়াসীম ময়মনসিংহ জেলার ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার আঠারোবাড়ি রায়পুর বাজারের মেসার্স কলিম উদ্দিন স্টোরের প্রোপাইটার ওয়াসীম আকরাম। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-বি এর ১-বি ধারায় ৮/১২৯ নং মামলা রুজু করে আদালতে প্রেরণ করেন। বিজ্ঞ আদালত আসামীদের জেলহাজতে প্রেরণ করেন।
৯ সেপ্টেম্বর ভোর সোয়া ৬ টার সময় কিশোরগঞ্জের নীলগঞ্জ-তাড়াইল রাস্তা একটি তল্লাসী চালিয়ে ১৪ হাজার ৮৫০ কেজি সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর তীর চিনির ছাপা বস্তায় ভারতীয় চিনি জব্দ করেন র্যাব-১৪। এসময় তাড়াইল উপজেলার কৌলিগাতি গ্রামের মৃত আব্দুস সোবহান খানের পুত্র বায়েজিত খান (৪৮), কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ঝালুপাড়া
গ্রামের জাফর আলীর পুত্র জাহাঙ্গীর (২৭) ও পাকুন্দিয়া উপজেলার মাইজহাটি গ্রামের মৃত মীর হোসেনের পুত্র ট্রাক চালক আশরাফকে আটক করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা নেত্রকোণার সীমান্ত হতে চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে আনা ভারতীয় চিনি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি করার কথা স্বীকার করেন। নেত্রকোণার মেছুয়া বাজারস্ত চিনি ব্যবসায়ী স্বপন জানান, প্রায় ৭ বছর ধরে তিনি চিনি ব্যবসার সাথে জড়িত। প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ টন চিনি বিক্রি করতেন। ভারত থেকে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে চিনি আসায় এখন প্রতি মাসে ১ টন চিনি বিক্রি করা কঠিন হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
চিনির ডিলার সাদেক ভুইয়া জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি চিনির ব্যবসা করেন। প্রতিমাসে গড়ে ১০০ টন চিনি বিক্রি হলে ভারত থেকে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে চিনি আসায় বর্তমানে ৪০ টনের উপর বিক্রি হয় না। চিনির ব্যবসা কমে যাওয়ায় অন্য ব্যবসার দিকে বেশি মনযোগ দিতে হচ্ছে। সাদেক ভুইয়া বলেন, দেশে বছরে মাত্র ৮০-৯০
হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়ে থাকে। যা দেশের সর্বোচ্চ ১৫-২০ দিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লক্ষ টন চিনি আমদানী করতে হয়। সীমান্ত পথ দিয়ে অবৈধ ভাবে চিনি আসায় সরকার শত কোটি টাকার
রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চিনি ব্যবসার সাথে জড়িতরা। হঠাৎ করে অবৈধ পথে চিনি আসা বন্ধ হলে দেশে চিনির সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে তিনি আশংখা প্রকাশ করেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-র্যাব চিনি জব্দ করছেন, চিনির সাথে আটককৃতরা বলছেন, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা ভারতীয় চিনি। এবিষয়ে জানতে ৩১ বিজিবি’র সিও লে. কর্নেল আরিফুর রহমানকে মোবাইল ফোনে অবহিত করলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন। একাধিকবার অফিসে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাক্ষাৎ না পাওয়ায় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। তারপরও তিনি কোন উত্তর দেন
নাই।
মন্তব্য করুন: