প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:০০
দেশব্যাপী সড়কে অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার প্রতিবাদ ও ছয় দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ সারাদেশে রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
একই সঙ্গে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে দিনভর অবস্থান কর্মসূচি শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নতুন এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী।
এর আগে ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়’ নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য একটি উন্নতমানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ছয় দফা দাবিতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের আওতাভুক্ত শিক্ষার্থীদের জোট ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন’।
গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত টানা ছয় ঘণ্টা শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ যায়। সাতরাস্তা ও আশপাশের এলাকার সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সড়কে চলাচলকারী মানুষ পড়েন সীমাহীন দুর্ভোগে। ঢাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারাদেশে জেলায় জেলায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান, ঢাকা পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ মো. মোস্তাফিজুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তবে বৈঠকে আমরা একমত হতে পারিনি।
তারা লিখিতভাবে আমাদের দাবিগুলো মেনে নেননি। তাই আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করছি। এ সময় তিনি সারা দেশের পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান।
বিকাল সোয়া ৪টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হন শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শোয়াইব আহমাদ খান। তিনি জানান, পদোন্নতিতে ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের’ কোনো কোটা রাখা হবে না।
এমনকি ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর’ নামে পদই রাখা হবে না। পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এমন ঘোষণা দিয়ে কারিগরি অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, ‘আদালতের রায়ে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে পদোন্নতিতে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ কোটা রাখার কোনো বিষয় নেই। তবুও আমরা আপিল করেছি।
শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে আদালত থেকে বিষয়টি সুরাহা হয়ে আসবে।’ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে আমরা একমত। আমরাও চাই দাবিগুলো পূরণ হোক।
তাই দাবি পূরণের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে।’ তবে ডিজি ও অধ্যক্ষের আশ্বাসের পরও সাতরাস্তা মোড়ে অবস্থান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ‘প্রত্যেকটি দাবি পূরণে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- লিখিতভাবে তা জানাতে হবে।’
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সাতরাস্তা মোড়ে বৃষ্টিতে ভিজে স্লোগান দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে আশ্বাস দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা রাস্তা না ছাড়ায় কারিগরি অধিদপ্তরের ডিজি পলিটেকনিক ইনস্টিটিটিউটের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন।
ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থানকালে তারা সেখানে জোহরের নামাজ আদায় করেছেন। সাতরাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় এফডিসি মোড় থেকে হাতিরঝিল এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
যানবাহন থমকে যায় এক্সপ্রেসওয়ের উপরেও। সাতরাস্তায় সড়ক অবরোধকারীদের মধ্যে সরকারি- বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাভুক্ত শিক্ষার্থীরা ছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা প্ল্যাকার্ড হাতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। ছয় দফা দাবি মানার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে আমাদের কাছে আসতে হবে। সচিবালয়ে কেউ যাবে না।’
বিক্ষোভের বিষয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাহেল রানা ও মেকানিক্যাল বিভাগের সপ্তম পর্বের শিক্ষার্থী মিঝদাহুল ইসলাম জানান, ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে গত সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন সময় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার শুধু আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দাবি পূরণ হচ্ছে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে থাকবেন।
তারা বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ দাবি হলো ল্যাব এসিস্টেন্টদের ১৬তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। কারণ, আমরা চাই না, কেউ পিয়ন হিসেবে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে আমাদের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’
তারা আরো বলেন, আমাদের এই ন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের অনেক শিক্ষকও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। বিকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শোয়াইব আহমাদ খানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তারা এ অধিদপ্তরে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কর্মকর্তাকে মহাপরিচালক নিয়োগের দাবি জানান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাতরাস্তা অবরোধ করার কারণে মগবাজার থেকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত সড়কে সরাসরি প্রভাব পড়ে। এই সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
আবার বিজয় সরণি উড়ালসড়ক দিয়েও গাড়ি পার করা যায়নি। এতে বিজয় সরণিতে যানজটের তৈরি হয়। সড়ক অবরোধের কারণে হোটেল সোনারগাঁও ও হাতিরঝিল এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
ছয় দফার মধ্যে যা আছে: ছয় দফা দাবির মধ্যে আছে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ প্রমোশন কোটা বাতিল করতে হবে। জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতির রায় হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করতে হবে। ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তন, মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত করতে হবে।
২০২১ সালে রাতের আঁঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি, ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যে কোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিল করতে হবে। উন্নত বিশ্বের আদলে চার বছর মেয়াদি মানসম্পন্ন কারিক্যুলাম চালু করতে হবে এবং একাডেমিক কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে করতে হবে। তৃতীয় দাবি, উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমান (১০ম গ্রেড) থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও যেসব সরকারি, রাষ্ট্রীয়, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিম্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থ দাবি, কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, সহকারী পরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা আইনানুগভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
এই পদগুলোয় অনতিবিলম্বে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ ও সব শূন্য পদে দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। পঞ্চম দাবি, স্বতন্ত্র ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও ‘কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে হবে। ষষ্ঠ দাবি, পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে একটি উন্নত মানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পাশাপাশি নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (নড়াইল, নাটোর, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁও) পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস এবং ডুয়েটের আওতাভুক্ত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আগামী সেশন থেকে শতভাগ সিটে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন: